“এরিনার মানুষরা আজ ম্যাচের শেষ ৪০ মিনিট ইতিহাসের সেরা মহিলা দলের সেরা বাস্কেটবল দেখলেন। কিন্তু তাঁরা জানেন না ওই চল্লিশ মিনিট আসলে ঠিক কী ছিল। অপরিসীম পরিশ্রম আর কষ্টকর যাতায়াতের ফল নয়। তার চেয়ে বেশি কিছু। মহিলা এবং পুরুষ, দর্শকাসনে কাপকেক বিক্রি করে খেলার পোশাক কিনতে হয় যাদের, একটা স্কলারশিপের জন্য অ্যাথেলিটকর্তাদের কাছে দৌড়তে হয়, দশকের পর দশক পর ধরে ‘দ্বিতীয় শ্রেণি’ হিসেবে দেখে আসা দৃষ্টিভঙ্গিকে মেনে না নেওয়া। যে দেশে মেয়েদের জন্য একটা খেলার টুর্নামেন্ট পর্যন্ত নেই, সেখানেই খেলার প্রতি ভালোবাসা ধরে রাখা বিশ্বাসের জয়। একটা অলিম্পিক যথেষ্ট নয়।”
কথাগুলো তারা ভ্যান্দারভারের। ১৯৯৬-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহিলা বাস্কেটবল দলের প্রশিক্ষক ছিলেন তিনি। সেবার বাস্কেটবলে সোনা জিতেছিল দল।
১৯০০ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসে অলিম্পিক গেমসের দ্বিতীয় আসরে মেয়েদের জন্য খোলা হয় অলিম্পিক গেমসের দরজা। সেবার প্রতিযোগিতায় মোট প্রতিযোগী ছিলেন ৯৯৭ জন। তার মধ্যে মেয়ে ২২ জন। টেনিস আর গলফ এই ছিল বরাদ্দ। মোট প্রতিযোগীর ২.২ শতাংশ।
এই ঘটনার ৯৬ বছর পরেও পৃথিবী জয়ের মঞ্চে দাঁড়িয়ে বৈষম্যের বিরুদ্ধেই আওয়াজ তুলেছিলেন তারা।
২০১২-এর লন্ডন অলিম্পিকে মহিলা ক্রীড়াবিদদের সংখ্যাটা ছিল মোট প্রতিযোগীর ৪৪ শতাংশ।
২০২১- টোকিও অলিম্পিকে মোট প্রতিযোগীর ৪৮.৮ শতাংশ মহিলা ক্রীড়াবিদ।
২.২ থেকে ৪৮.৮- মাঝখানে ১২১ বছর। বছর মাস দিন সংখ্যায় মাপা যায়, কিন্তু রক্ত-ঘাম-ঝরানো লড়াই সংখ্যায় গোনা যায় না।
গোটা পৃথিবীর ক্রীড়াপ্রেমি বিশেষত মহিলা ক্রীড়াবিদদের কাছে এবারের টোকিও অলিম্পিক এক অভূতপূর্ব প্রতিযোগীতা। শুধুমাত্র তিন-তিনবার বাতিল হওয়ার কারণে নয়, টোকিও অলিম্পককে ক্রীড়াক্ষেত্রে নারীশক্তির জয় হিসেবে দেখছে নারী বিশ্ব।
চীন, আমেরিকা, ব্রিটেনের মতো প্রথম সারীর দেশগুলো টোকিও অলিম্পকে যে টিম পাঠিয়েছে তাতে পুরুষ প্রতিযোগীর তুলনায় নারীদের সংখ্যা অনেকটাই বেশি। এ ব্যাপারে একেবারে শীর্ষে রয়েছে চীন। চীনা ক্রীড়াবিদদের ২৯৮ জন নারী এবং ১৩৩ জন পুরুষ। আমেরিকার ৩২৯ জন মহিলা এবং ২৮৪ জন পুরুষ। পরের নামগুলো যথাক্রমে ব্রিটেন, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার।
গত মার্চেই ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির সভাপতি থমাস বাক জানিয়েছিলেন, টোকিও অলিম্পিক-২০২০ প্রথম ‘জেন্ডার-ব্যালেন্সড’ অলিম্পিক প্রতিযোগিতা । অতীতে পৃথিবীর আর কোনও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এত বেশি সংখ্যক নারী ক্রীড়াবিদদের অংশগ্রহণের নজির নেই।
তিনি জানিয়েছিলেন, “ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি একটি বার্তা দিতে চায়, অলিম্পকে লিঙ্গ-সমতার বিষয়টি বাস্তব করা সম্ভব হয়েছে”।
সেই দিক থেকে দেখতে গেলে টোকিও অলিম্পিক সব দিক থেকেই ‘গ্রেটেস্ট’। ক্রীড়া দুনিয়ার মাইলস্টোন বর্ষ বলা যেতেই পারে।
কেন অলিম্পিক ঘিরে লিঙ্গ-সমতার বিষয়তি গত ১০০ বছরের বেশি সময় ধরে বারবার উঠে এসেছে আলোচনায়। অলিম্পিক শুরুর সময় থেকেই পুরুষপ্রধান। উনিশ শতকে যখন মহিলাদের জন্য সুযোগ করে দেওয়া হল সেখানেও গন্ডি।
‘মেয়েরা দুর্বল’ তাই খেলার মাঠ থেকে তারা দূরে থাকবে- এই ট্যাবুই যেন বহুদিন ধরে ঘোরা-ফেরা করত প্রতিটি নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে। পিয়ের দ্য কুবেরত্যাঁর অলিম্পকে মহিলাদের অংশগ্রহণসংক্রান্ত ধারণা পরবর্তী সময়ে বদলে ঘটতে থাকে।
তবুও ১৯৯২-র অলিম্পিকে প্রায় ৩৫ টি দেশ সকল ইভেন্টের জন্য শুধুমাত্র পুরুষ প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল।
২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি ঘোষণা করে যে যেসব রাষ্ট্র নারী ক্রীড়াবিদ পাঠানোর ব্যপারে আগ্রহী না তাদের উপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করা হবে। তারপরই বাহারিন, সৌদি আরব, কাতারের মতো দেশগুলো মহিলা প্রতিযোগী পাঠানোর ব্যাপারে নড়েচড়ে বসে।
আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিতির প্রতিষ্ঠাতা পিয়ের ডি ফ্রাডি নিজেও বোধহয় মহিলা ক্রীড়ার বিষয়টি নিয়ে ভালমতো আন্দাজ করতে পারেননি। ক্রীড়া মানেই তা পুরুষের এই প্রচলিত ধারণা জাঁকিয়ে ছিল শুরু থেকে।
ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় নারীদের স্থান শুধু দর্শকাসনে। তাও সব ধরনের খেলার ক্ষেত্রে নয়। দর্শকাসনেই যখন এত বাধা খেলার মাঠে যে প্রবেশ আরও কঠিন হবে সেটাই স্বাভাবিক ছিল।
খেলার দুনিয়ায় খেলোয়াড় হিসেবে মেয়েদের দেখার লড়াইটা তাই মেয়েদের নিজেদেরই শুরু করতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত জিতেছিল তারাই।
অলিম্পিকে মহিলাদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে বারবার প্রতিবাদ উঠেছে। কখনও পোশাক নিয়ে, কখন বা ম্যাচের স্লট নিয়ে। ২০১২-র আগে পর্যন্ত মেয়েদের বক্সিং অলিম্পিক ইভেন্ট তালিকাভুক্ত ছিল না। ১৯০০ থেকে শুরু করে প্রতিবারই অলিম্পিকে মেয়েদের ক্রীড়া তালিকায় নতুন নতুন নাম যোগ হয়েছে। এ বছর নতুন ১৮টি ইভেন্ট শুরু হয়েছে।
প্রতিযোগিতায় মহিলা ক্রীড়াবিদদের ম্যাচ দুপুরের স্লটে রাখা হত। এমনি ফাইনাল ম্যাচ হলেও। সন্ধের প্রাইমটাইম পুরুষ-প্রতিযোগীদের জন্য।
ম্যাচ শিডিউলেও এসেছিল লিঙ্গ-বৈষম্যের অভিযোগ। তবে প্রতি অলিম্পিকেই লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে ইতিবাচক কাজ করে চলেছে অলিম্পিক কমিটি।
২০২০ টোকিও অলিম্পিকে কমিতির লক্ষ্যই ছিল ৫০ শতাংশ মহিলা অংশগ্রহণ। ৪৮.৮ শতাংশ মহিলা ক্রীড়াবিদ অংশগ্রহণ করছেন এবার। অলিম্পকের ইতিহাসে এটাই সর্বোচ্চ হার। শুরু থেকেই নজর কাড়ছেন তাঁরা।
এই লড়াই গোটা পৃথিবীর মেয়েদের লড়াই। ভারতও সেই লড়াইতে ছিল নিজের মতো করেই। পিটি ঊষা থেকে মেরি কম পর্যন্ত। লড়াইয়ের পথ কম নয়। এই লড়াই কারুর একার লড়াইও নয়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, অতীত থেকে ভবিষ্যতে প্রশস্ত হয়েছে পথ। তারই আলোয় উজ্জ্বল এবারের অলিম্পিক।
টোকিও অলিম্পিকে এবারে ভারতের মোট প্রতিযোগী ১২৭। মহিলা ক্রীড়াবিদ ৫৬। পুরুষ ৭৭। আয়োজক দেশ জাপানের ৫৫২ মোট প্রতিযোগির মধ্যে ২৯৩ জন পুরুষ এবং ২৫৬ মহিলা।