বৈদিক সমাজে নারীদের পড়াশোনা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি বেশ কয়েকটি পর্ব ধরে। নারীদের অবস্থান যে বিশেষ সম্মানজনক ছিল সে বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণও পাওয়া গেছে। নারীরা পড়াশোনার সুযোগ পেতেন।
সেই শিক্ষা নেহাতই পুঁথিগত বিদ্যার গণ্ডিতে আটকে থাকত না। সেই শিক্ষার প্রয়োগ করতে বহু উদ্যোগ নিয়েছেন বৈদিক নারীরা। তাঁরা প্রয়োজনে বৈদিক সমাজের নিয়মকে প্রশ্ন করেছেন। নিয়ম বদলের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগও নিয়েছেন সাহসের সঙ্গে। তার জন্যে তাঁরা কখনো লড়াই করেছেন পুরুষের সঙ্গে কখনো লড়াই করেছেন অন্য নারীদের সঙ্গে। বৈদিক নারীদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল তাঁদের গোষ্ঠীবদ্ধ হওয়ার ক্ষমতা।
বৈদিক নারীরা নিজেদের আত্মাকে যতটা সম্ভব কলুষমুক্ত রাখার চেষ্টা করতেন। আত্মার সাধনা করতেন তাঁরা। অন্তরাত্মা যাতে বিশুদ্ধ থাকে, যাতে সঠিক পথে চলতে পারে তার সাধনা করতেন বৈদিক নারী ঋষিরা।
বেশিরভাগ বৈদিক নারী-ঋষি বা ঋষিকারা তাঁদের বাবাদের থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তেমনই এক নারী ঋষি ছিলেন ঋষি দক্ষিণা।
ঋষি প্রজাপতির কন্যা ছিলেন এই ঋষি দক্ষিণা। মেধাবী, বিদূষী এই ঋষিকা ছোট থেকেই ঋকবেদের চর্চা করতেন। বাবার থেকেই মূলত মন্ত্র-চর্চা শিখেছিলেন তিনি।
একটা বিষয় এই ঋষিকাকে বিব্রত করত। ঋষি প্রজাপতি ছিলেন যজ্ঞ সম্পন্ন করতে পারার ক্ষমতাবান ঋষি। দক্ষিণা দেখতেন বাবা কোন যজ্ঞ সম্পন্ন করার শেষেও খালি হাতে ফিরতেন। কখনও কোন পরিবার থেকে বিশেষ কোনও উপহার বা উপঢৌকন দেওয়া হলে আলাদা কথা নইলে সম্মান-দক্ষিণা বা কোন সাম্মানিক দেওয়ার রীতি ছিল না সেই সময়। এই বিষয়টা ঋষি দক্ষিণাকে বিব্রত করেছিল। প্রশ্ন জেগেছিল তাঁর মনে। তাঁর মনে হয়েছিল এমন পবিত্র বিশেষ কাজ সম্পন্ন করার পর ঋষিদের কোন সম্মান-দক্ষিণা দেওয়া হবে না কেন!
ঋকবেদের যুগে সেই সময় পুজোআচ্চা বা কোন যজ্ঞ সম্পন্ন করার পর দক্ষিণা দেওয়ার রীতি ছিল না। এই সংক্রান্ত কোনো মন্ত্র ছিল না। ঋষি দক্ষিণা তখন এই বিষয়ে মন্ত্র রচনা করেছিলেন।
তাঁর মতে যে কোন পবিত্র, সাধনাসর্বস্ব কাজের পুরস্কার-স্বরূপ কিছু থাকা উচিত। সেই ভাবনা থেকেই ঋকবেদে ঋষিদের দক্ষিণা দেওয়ার মন্ত্র রচনা করেছিলেন ঋষিকা দক্ষিণা।
তার মতে এই সম্মান-দক্ষিণা বা উপহার বা পুরস্কার উৎসাহিত করবে কাজকে। যজ্ঞ সম্পন্ন হওয়ার পর সেই ঋষির প্রশংসাও প্রাপ্য বলে মনে করতেন ঋষি দক্ষিণা। ঋক বেদের ১০৭ তম সূক্তের ঋষি তিনি। ঋকবেদের দশম মণ্ডলের ১০৭ তম সূক্তের মন্ত্রগুলি রচনা করেছিলেন ঋষি দক্ষিণা। তাঁর রচিত প্রত্যেকটি মন্ত্রই যজ্ঞ সম্পন্ন করার পর ঋষিদের পুরস্কার বা উপহার দেওয়ার কথা বলে।
পুজোর পর পুরোহিত বা ঋষিদের উপহারস্বরূপ দক্ষিণা দেবার প্রথাটি ঋষি-দক্ষিনার মন্ত্র রচনা করার পর থেকেই শুরু হয়েছিল। ঋষি দক্ষিণা মহিলা পুরোহিতদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম অনুসরণ করার কথা বলে গেছেন।
বৈদিক যুগে নারীরা এমনই সম্মানীয় অবস্থানে ছিলেন যে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়েছিল সমাজের রীতিনীতি। এইসব নারীরা নিঃসন্দেহে সমাজের যেকোনো ক্ষেত্রের দৃষ্টান্ত।