ভারতের পরিবেশ আন্দোলনে নারীরা

ভারতে পরিবেশ আন্দোলনের এক সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে, সেই বিষ্ণোইদের সময় বা চিপকো থেকে শুরু করে প্রতিটি পরিবেশ তথা গাছ বাঁচাও আন্দোলনে আমরা নারীদের পেয়েছি। আন্দোলনের পুরোভাগের নেতৃত্বে এবং লড়াইয়ের ময়দানেও তাঁরা স্বমহিমায় শাশ্বত। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস এবংঐতিহ্য এমনই; সেই রকমই বীরঙ্গনাদের বীরগাঁথা গল্প বলব আজ, অরণ্য রাজ্যের অরণ্য বাঁচাও আন্দোলনের বীরসেনানীদের কথা!
 
একটি ভারতীয় আদিবাসীজাতি হল বিষ্ণোই, এরা মূলত ছিল পরিবেশ ও অরণ্য নির্ভর একটি জাতি। এদের উৎপত্তি ঘটে ৬০০-৬৫০ বছর আগে, যদিও এই বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছু মত পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আজও এরা রয়েছেন রাজস্থানে, চেষ্টা করে যাচ্ছেন প্রকৃতি রক্ষার। বিষ্ণোইরা হলেন ভগবান বিষ্ণুর উপাসক এবং তার থেকেই এদের এই নামের উৎপত্তি। অন্যমতে মনে করা হয় যে, বিষ্ণোইরা যে ২৯টি নিয়ম মেনে চলত তার থেকে স্থানীয় ভাষা অনুযায়ী ২০ এবং ৯থেকে বিশ ও নই; এই দুই মিলে বিষ্ণোই শব্দের সৃষ্টি। বিষ্ণোইরা প্রকৃতিকে ঈশ্বর ও শক্তির উৎস রূপে পুজো করেন। বিষ্ণোইদের গুরু হলেন গুরু জাম্বেশ্বর (১৪৫১-১৫৩৬)। বিষ্ণোইরা প্রধানত ২৯টি নিয়ম মেনে চলেন যেমন প্রাণী রক্ষা, পরিবেশ রক্ষা, বৃক্ষ রক্ষা, জল সংরক্ষণ, পরিবেশ সংরক্ষণ ইত্যাদি। বিষ্ণোইরা কোন প্রাণী হত্যা করেন না। তাদেরই প্রচেষ্টায় রাজস্থানের শুষ্ক মরুভূমির কিছুটা অংশ সবুজে পরিণত হয়। 
 
বিষ্ণোইরা রাজস্থানের যোধপুরের কাছে একটি জনপদে বসবাস করত, ১৭৩০ সালে এই বিষ্ণোইরাই প্রথম অরণ্য এবং গাছ বাঁচানোর আন্দোলন করেন, যার নেত্রী ছিলেন বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের এক মহিলা অমৃতাদেবী।
amrita devi
 
এই আন্দোলনই ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় এবং প্রভাবশালী পরিবেশ আন্দোলন চিপকো আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল। যা একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেদিয়েছিল। বিষ্ণোইদের এই আন্দোলনই চিপকোর বীজ বপন করেছিল। আন্দোলনের সূত্রপাত হয় রাজস্থানের যোধপুরের কাছে খেজরিলি নামক একটি ছোট গ্রামে। গ্রাম টিতে প্রচুর পরিমানে খেজরি (খেজুর) গাছ ছিল। রাজস্থানের মেওয়ারের রাজা অভয় সিং তার নতুন রাজপ্রাসাদ তৈরি করার জন্যে ওই গ্রামের গাছ কাটার জন্য কাঠুিয়াদের পাঠান আর সাথে সাথে শুরু হয় সবুজের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম। তিন সন্তানের মা অমৃতাদেবী শুরু করেন আন্দোলন, জড়িয়ে ধরেন গাছগুলোকে। পরিবেশের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই আর মাননবতার অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই একাত্ব হয়ে যায়। রাজার লোকেদের হাতে তিন সন্তানসহ অমৃতাদেবী প্রাণ হারান।  এই আন্দোলনে সর্বমোট 363জন বিশনই  আত্মবলিদান দেন। তারা মৃত্যুর আগে পর্যন্ত গাছ ছাড়েননি, জড়িয়ে ধরে রাখেছিলেন গাছগুলোকে। যা পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে এক অনন্য নজির, এই আন্দোলন অমৃতা দেবীর আন্দোলন নামেই পরিচিত। পরবর্তীতে কিছু দিনের মধ্যেই উত্তরপ্রদেশ, হিমালয় পার্বত্য অঞ্চল, এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং এই আন্দোলনই হল ভারতের প্রথম পরিবেশ আন্দোলন।
 
 
এবার আরেক কাহিনী, ছেলেবেলায় পড়া টারজানের কথা মনে পড়ে? সেই যে জঙ্গলে বেড়ে ওঠা নাম না জানা একা এক শিশু? অরণ্যই তার জীবনে, পশু পাখি আর জঙ্গলকে ভালবেসে চলা, উভয়ের উভয়কে রক্ষা করা। কারণ, জঙ্গলই ছিল তার জীবনদাত্রী, তার মা, তার বন্ধু তার আশ্রয় সব কিছু। অনিন্দ্য সুন্দর এক উপাখ্যান ! 
 
 
এই বীরঙ্গনাও টারজানের মতোই অরণ্যপ্রেমী এবং অরণ্যের সুরক্ষায় নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন কিন্তু টারজানের মতো তিনি কোনও বিদেশী গল্প-কাহিনীর চরিত্র নন। বরং এই ভারতেই সাক্ষাত মেলে তাঁর। তিনি অরণ্য রাজ্যের যমুনা টুডু। অরণ্যের রক্ষার্থী স্থানীয়দের ভাষায় 'দ্য লেডি টারজান'।
 
jamuna tudu
 
ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূমের চাকুলিয়ার বাসিন্দা যমুনা টুডু। বিয়ের আগে তাঁর ঠিকানা ছিল ময়ূরভঞ্জ। সেখানেই রুক্ষ জমিতে গাছের চারা রোপন করে তাদের যত্নসহকরে বড়ো করতেন যমুনা দেবীর বাবা। ফলতই বাবাকে দেখে শৈশব থেকেই গাছের প্রতি এক নিঃস্বার্থ ভালোবাসা জন্মায় যমুনাদেবীর। বিয়ের পর ঝাড়খণ্ডে আসেন তিনি। তারপর থেকেই নিঃসন্তান এই আদিবাসী মহিলার কাছে জঙ্গলই যেন হয়ে ওঠে তাঁর আত্মজ। আর সেই 'সন্তান'-এর রক্ষাতেই বারবার এগিয়ে এসেছেন তিনি। প্রায় দেড় দশক ধরে তিনি অরণ্য রক্ষায় ব্রতী হয়েছেন। প্রায় একাহাতেই কাঠ মাফিয়া এবং গাছ চোরাচালানকারীদের প্রতিহত করেছেন। সম্বল বলতে ইচ্ছাশক্তি, হার না মানা মনোভাব আর অসীম সাহস; এই জিনিসের ওপর ভর করেই আজ তিনি ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলের রাণী, জঙ্গলের রক্ষার্থী।
 
১৯৮০ সালে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার রায়রংপুরে এক আদিবাসী কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন যমুনাদেবী। দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর, ১৯৯৮ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে রায়রংপুর থেকে ১০০ কিমি দূরে অবস্থিত ঝাড়খন্ড-এর পূর্বে সিংভূম জেলার মুতুরাখাম গ্রামের মান সিং টুডুর সাথে বিবাহ হয় যমুনা দেবীর। মান সিং টুডু পেশায় একজন ক্ষুদ্র মানের কনট্রাকটর, তিনি গ্রামে গ্রামে বাড়ি তৈরি করেন। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে এসে আর পাঁচজন সাধারণ গৃহবধূর মতো থাকেননি তিনি বরং শুরু করেন অরণ্য বাঁচানোর এক অসাধারণ সংগ্রাম। চাকুলিয়ার বিয়ে হয়ে আসার পর যমুনা দেবীর নজরে আসে আশেপাশের শাল বন কেটে গাছ পাচারের ঘটনা। এরপরই অভিযানে নেমে পড়লেন তিনি। শুরু হল লড়াই। প্রতিনিয়ত জঙ্গল বাঁচানোর ভীষণ সংগ্রাম। কোথাও কোনও গাছ কাটার খবর পেলেই ছুটতেন তাঁরা। হাতে নাতে ধরতেন অপরাধীদের। তবে এই কাজ মোটেও সহজ ছিল না। গাছ চোরাচালানকারীদের রুখতে গিয়ে বহুবার আঘাতও পেয়েছেন যমুনা দেবী। ১৯৯৮ সালে যমুনা টুডু নিজে এবং সাথে আরও পাঁচ জন স্থানীয় মহিলাসহ 'বন সুরক্ষা সমিতি' গড়ে তােলেন। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে বন বাঁচানাের এই উদ্যোগে তীব্র বিরোধিতা আসে সাধারণ গ্রামবাসীদের তরফ থেকেই, কারন গ্রামবাসীদের কাছে বন হল জ্বালানি কাঠের প্রধান উৎস। যমুনাদেবীরা স্থানীয় মানুষদেরর সচেতনতা তৈরি করতে থাকেন যে, জ্বালানি হিসেবে ছোট ডালপালা ব্যবহার করতে হবে, এবং যতটা সম্ভব বড় গাছ না ব্যবহার করাই উচিত। তাতেই রক্ষা পাবে অরণ্য। সেইসময় ঝাড়খন্ড রাজ্যের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলে জুড়ে বন মাফিয়াদের রাজত্ব চলত।
 
বেআইনিভাবে জঙ্গল কেটে  মুনাফা অর্জন ছিল উপার্জনের একটি সহজ মাধ্যম। বন-মাফিয়া এবং কাঠ চোরাচালানকারীদের থেকে হুমকি,বাধা পেয়েও থেমে থাকেননি যমুনাদেবী। বন্দুকবাজ বন-মাফিয়াদের বিরুদ্ধে লাঠি, তীর-ধনুক, বর্শা হাতেই স্থানীয় মহিলারা তাঁর নেতৃত্বে  বনরক্ষার লড়াই শুরু করেন।
 
আস্তে আস্তে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। স্থানীয় গ্রামবাসীদের মধ্যে অরণ্য সংরক্ষণের গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। বন-মাফিয়াদের কাছ থেকে যমুনাদেবী খুনের হুমকও পেয়েছেন। ২০০৪ সালে চাকুলিয়া শহরে তাঁর বাড়িতে হামলা হয়। ২০০৮ সালে যমুনাদেবী ও তাঁর স্বামীর ওপর প্রাণঘাতী হামলা হয়। অল্পের জন্য প্রাণে তাঁরা রক্ষা পান। তবুও এই  সাহসী নারী পরিবেশ বাঁচানোর লড়াই ছাড়েননি।মুতুরখাম গ্রামসংলগ্ন প্রায়  ৮০ একর বনভূমি বাঁচাতে সক্ষম হয়েছে এই বীরাঙ্গনার নির্ভীক লড়াই। এখন বর্তমানে  "বন সুরক্ষা সমিতির", ৩০০ টি দল রয়েছে এবং প্রত্যেক দলে ৩০ জন করে সদস্য রয়েছেন। তাঁরা যমুনাদেবীর নেতৃত্বে আজও বনভূমি বাঁচাতে নিরলস কাজ করে চলেছেন। এখন ঝাড়খন্ড পুলিশ ও বন বিভাগ তাঁদের নিয়ে যৌথভাবে বনরক্ষার কাজ পরিচালনা করেন। ঝাড়খন্ড সরকার বর্তমানে যমুনাদেবীর গ্রামটিকে দত্তক নিয়েছেন। শিক্ষা ও জল পরিষেবার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে। যমুনাদেবীদের নিরলস লড়াইয়ে সুফল হিসেবে বলা যায়, বর্তমানে তাঁর গ্রামে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হলে ১৮টি গাছ এবং একটি মেয়ের বিয়ে হলে ১০ টি গাছ লাগানোর নিয়ম চালু রয়েছে।
 
যমুনাদেবী গাছকে ভাই-এর চোখে দেখেন। প্রতিবছর রাখীবন্ধনের দিন তিনি ও তাঁর বন সুরক্ষা সমিতির সদস্যরা গাছে রাখী বাঁধেন। অরণ্য সংরক্ষণে সাফল্যে এবং পরিবেশ রক্ষায় অবদানের জন্যে, স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি একাধিক পুরষ্কার পেয়েছেন। ২০১৪ সালে স্ত্রী শক্তি পুরস্কার, গডফ্রে ফিলিপস সাহসিকতা পুরষ্কার ইত্যাদি। ২০১৯ সালে ভারত সরকার যমুনাদেবীর অরণ্য সংরক্ষণের নিরলস উদ্যোগকে সম্মান জানিয়ে পদ্মশ্রী পুরস্কার প্রদান করে।
 
 
 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...