আজকে যে সমাজে আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি, যতই সদর্থক ভাবি না কেন, চারদিক থেকে অস্থিরতা আমাদের গ্রাস করেছে তা আমরা কিছুতেই অস্বীকার করতে পারব না। এ হেন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাঁদের মত করে পর্যালোচনা করছে, করবেও। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ, বা আর একটু গুছিয়ে বললে যারা একটু সমাজ সচেতন সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ তারা কি করি বলুন তো? আমাদের বলা না বলা কতটা গুরুত্ব রাখে এই অস্থির সময়ে? তাই আমরা বিভিন্ন জন, যার যে দিকে ভাললাগা রয়েছে, সে সেই মাধ্যমকে সঙ্গী করে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করি। এবারে এখানেও আছে আর একটি গন্ডি। আমাদের মধ্যেও অর্থাৎ সাংস্কৃতিক মানসিকতার মানুষজনদের মধ্যেও রয়েছে কিছু মতপার্থক্য। যা হওয়াটাই স্বাভাবিক। তো সবকিছু নিয়ে চলতে চলতে সাংস্কৃতিক মাধ্যমগুলো নিজেদের ডালপালা মেলেছে।
নতুন একটি মাধ্যম পথ চলতে শুরু করেছে সম্প্রতি। ছোট ছবি বা শর্ট ফিল্ম। ছোট বা বয়সে নবীন হলেও এই ছবির ভাষা কিন্তু দৃপ্ত। তার কথা বলার মধ্যে আলাদা বোধ রয়েছে। এবারে এই মাধ্যমটি নিয়ে অনেকেই চর্চা করছেন, তাঁদের বক্তব্য পেশ করছেন। আজকে এই মাধ্যমটির বিষয়েই কথা বলতে চাইছি। শহরে- সে আমাদের শহরই বলুন বা ভারত তথা পৃথিবীর অন্যান্য শহরের| নবীন প্রজন্মের ছবি করিয়েরা এই মাধ্যমকে আঁকড়ে ধরেছে। এখানেই তারা তাদের মনের ভাব ব্যক্ত করার উপযুক্ত জায়গা বলে মনে করছে। পাশাপাশি নিজেদের ছবি সমাজে ছড়িয়ে দিতেও তারা বদ্ধ পরিকর। তাই বিভিন্ন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল তথা বিভিন্ন জায়গায় ফিল্ম প্রোজেকশন-এর মাধ্যমে শর্ট ফিল্ম আজ শক্তপোক্ত জায়গা করে নিয়েছে। এরকমই একটি ফিল্ম প্রজেকশনের সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম কাউন্সিল বা আইএফসির। শহরের বিভিন্ন জায়গায় ছবি প্রদর্শনের পাশাপাশি বিভিন্ন গ্রামেও তারা ছোট ছবির প্রদর্শন করে থাকে।
নতুন বছরে তাদের নতুন অনুষ্ঠান সংঘটিত হয়ে গেল পার্ক সার্কাসের 'জানুস সেন্টার ফর ভিস্যুয়াল এন্ড পারফর্মিং আর্ট'-এ। গত ২০শে এপ্রিল অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানের বিষয় ছিল বিভিন্ন ভাবে নারীর চিত্রায়ন। পাশাপাশি অতিথি দেশ ছিল বাংলাদেশ। এই অনুষ্ঠানে আইএফসি-র সঙ্গী হয়েছিল গ্রীন তারা সোশ্যাল ইনিশিয়েটিভ এবং আইডব্লিউএসএফএফ। অনুষ্ঠানের শিরোনাম 'নানা রঙে নারী'। প্রদর্শিত হয়েছিল মোট আটটি ছবি। প্রতিষ্ঠানের সকলের মতে, পাকিস্তানের মালালা হোক বা বাংলাদেশের নুসরত, কংবা ভারতের আসিফা...শোষক, ধর্ষক বা পুরুষতন্ত্রের নগ্ন আধিপত্য দেশ-কাল-জাতি-ধর্মের বেড়া অতিক্রম করে বারবার। তার কুৎসিত কঙ্কাল সামনে আসে রোজ। তাই নিয়েই কথা বলেছে উক্ত অনুষ্ঠানের আটটি ছবি।
সায়ন্তন দত্তের 'আফটার আসিফা' যখন আসিফার সাম্প্রদায়িক ধর্ষণ ও হত্যার প্রেক্ষাপটে এক শিল্পীর যন্ত্রণার নিদান দেয়- দেবরাজ নাইয়ার 'ভয়েস অফ সাইলেন্স' তখন ধর্ষিতা অরুণা সানবাগ-এর নিঃশব্দ যন্ত্রণা সশব্দে ব্যক্ত করে। আবার একই সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থ ফলিয়ার 'জোঁক' কুমারী থেকে নারী সমস্ত বয়সের শোষিত, বলা ভালো ধর্ষিতা নারীর কথা বলে। দৃপ্ত প্রশ্ন করে, বৈবাহিক ধর্ষণের অবজ্ঞাকে। সমাজ ও শাসক যখন সমকামিতায় অসুস্থতা ও ধ্বংস খুঁজে পায়, অরিজিৎ কুণ্ডুর 'দি কেজড বার্ড' তখন দুই নারীর সম্পর্কে বন্দি হওয়ার মাধ্যমে সুস্থতা ও সৃষ্টির বার্তা বহন করে। তথাগত চ্যাটার্জীর 'তৃতীয় ছাদ'-এ বন্ধ দরজার ওপাশে খোলা আকাশে এক নারীর ঘুড়ি ওড়ানোর স্বাদ যদিও বা খানিক পূর্ণ হয়, পুরুষতন্ত্র লাটাই হাতে সে উড়ানে অদৃশ্য এক ছাদ হয়ে ভোঁ-কাট্টার বিষাদ ভরে দেয়। 'স্বর ও সতী' নিখিলেশ দিন্দার এই ছবিতে আমরা দেখতে পাই 'সতী' দাহ আজও হয়। রক্ত মাংসের নারীর ক্ষেত্রে না হলেও, পিতৃতান্ত্রিক পরিবার নারীর 'স্বর' কে দাহ করে প্রতিমুহূর্তে। জনার্দন ঘোষের 'অধরা'য় আমরা অনুধাবন করলাম কিভাবে ব্যক্তির অন্তর্দহন ব্যক্তির দেহ মনের গন্ডি অতিক্রম করে মহাজাগতিক হয়ে ওঠে নারীরূপী প্রকৃতিদেবীর সামনে। স্বপ্ন থেকে যায় অধরা। শান্তশ্রী চৌধুরীর ছবি 'স্প্রিং' শব্দ ও দৃশ্যের মেলবন্ধনে বসন্তের এক অমোঘ যাত্রার কাহিনী তুলে ধরে। যেখানে বসন্ত এক নারী, বরফের স্থাপত্যের রূপকে নারী বেদনা পরিস্ফুটিত হয়।
অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে। অনুষ্ঠানের গুরুত্ব খানিকটা বাড়িয়ে তুলেছিলেন অতিথি উজ্জ্বল বসু এবং অনির্বান মাইতি। বিকল্প ও স্বাধীন ছবিই বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ এবং গণঅর্থায়নে নির্মিত ছবি তৈরির অভিজ্ঞতা - বিষয়ে তাঁদের সুচিন্তিত মতামত অনুষ্ঠানকে ঋদ্ধ করেছিল। অনুষ্ঠানে উপস্থিত গ্রীন তারা ইনিশিয়েটিভ-এর তরফে এবং স্বাধীন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে শান্তশ্রী চৌধুরী বলেন, "ছোট ছবিকে আরও জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। বিভিন্ন বড় হলে বিশেষ করে মাল্টিপ্লেক্সগুলোতে যাতে ছোট ছবির প্রদর্শন হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। ছোট ছবির যাতে প্রযোজক তৈরী হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে আমাদের"। আবার আইএফসি-র তরফে পরিচালক সোম চক্রবর্তী বলেন, আমরা চেষ্টা করছি শুধু শহরের গন্ডির সীমাবদ্ধতায় নয়, গ্রামে গিয়ে পরবর্তী প্রজন্ম অর্থাৎ স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের ছোট ছবির বিষয়ে শিক্ষিত করে তুলতে। যাতে তারাও এই মাধ্যমেই নিজেদের কথা বলতে পারে"। আইএফসি-র তরফে আর একজন পরিচালক নিখিলেশ দিন্দা কিন্তু যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। তিনি বললেন, "ছোট ছবিই ভবিষ্যতের একমাত্র মাধ্যম হতে চলেছে। শর্ট ফিল্ম সমাজে রুল করবে। আমরা গ্রামে গ্রামে এই ছবি ছড়িয়ে দিতে চাই। গ্রামে শিক্ষিত দর্শক তৈরী আছে। তাদের কাছে পৌঁছতে হবে, এই ছবির ভাষা তাদের জানাতে হবে। তাই আমাদের এই প্রচেষ্টা"।