বিশ্বসাহিত্যের যে কয়েকজন বিরল প্রতিভা তাঁদের যুগোত্তীর্ণ অবদানের জন্য সময়ের সীমা অতিক্রম করে রীতিমত 'মহামানব' রূপে চিহ্নিত হয়েছেন, বিশ্ব ট্রেজেডির ফেরিওয়ালা- উইলিয়ম শেক্সপীয়র তাঁদের মধ্যে অন্যতম। আজ, ২৬ এপ্রিল সেই প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিতের জন্ম দিন।
মনস্তত্ত্ব এবং মানবিকতার অনন্য ট্র্যাজেডিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন এই কিংবদন্তী। ওয়ারউইক শায়ারে অ্যাভন নদীর তীরে স্ট্রাটফোর্ডে জন্ম শেক্সপীয়রের। এমনকি তাঁর এই জন্মস্থান জড়িত হয়েছে তাঁর উপর আরোপিত এক উপাধির সঙ্গে, সর্বজনবিদিত প্রভূত দক্ষতার অধিকারী শেক্সপিয়রকে ডাকা হয় ‘বার্ড অব অ্যাভন’ নামেও। উইলিয়মের শৈশব ও বাল্যকাল সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। যেটুকু জানা যায়- তাঁর জন্ম হয়েছিল ইংরেজ জোতদার পরিবারে। বাবা জন শেক্সপীয়র, মা মেরী আর্ডেন। এই ট্রেজেডি কিং-এর জীবনও ছিল ট্রেজেডিময়। সাত ভাইবোনের মধ্যে উইলিয়ম বাদে আর সকলে শৈশবেই মারা গিয়েছিল প্লেগে আক্রান্ত হয়ে। সেসময় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে প্লেগের প্রাদুর্ভাব ছিল মারাত্মকভাবে। ভাগ্যক্রমে তিনি প্লেগের প্রকোপ থেকে রক্ষা পান।
তাঁর বাবা জন শেক্সপীয়র স্ট্রাটফোর্ডের অল্ডারম্যান এবং কর্পোরেশনের বেলিফ নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই সরকারী পদে থাকাকালীনই মঞ্চাভিনয়ের প্রতি তাঁর আগ্রহ ও পৃষ্ঠপোষকতার কথা জানা যায়। বাইরে থেকে যে সব নাট্যদল শহরে আসত তিনি তাদের সরকারী অর্থসাহায্য পেতে সাহায্য করতেন। অনুমান করা যায় বাবার এই নাট্যপ্রীতিই উইলিয়মের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। বাবার দৌলতেই ছেলেবেলা থেকে বিভিন্ন মঞ্চ উপস্থাপনা দেখার সুযোগ পেতেন তিনি, তখন থেকেই তাঁর ভিতরে বেড়ে উঠতে থাকে কাব্য-নাটক-সাহিত্যের চারা।
আঠারো বছর বয়সেই বিয়ে করেন অ্যান হ্যাথাও-কে, অ্যান ছিলেন উইলিয়মের থেকে আট বছরের বড়। কম বয়সে বিয়ে, সন্তান সন্ততি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই বাড়ল সংসারের খরচ। বিব্রত উইলিয়ম চলে এলেন লন্ডনে, সংসার পড়ে রইল স্ট্রাটফোর্ডের বাড়িতে। লন্ডনে এসে তিনি ঢুকে পড়লেন একটা নাটকের দলে। সেখানে তাঁর কাজ হয় ফাইফরমাস খাটা আর নাটক লেখা। সেইকালে নাটক লিখিয়েদের তেমন মর্যাদা দেওয়া হত না। থিয়েটারের আর পাঁচজন কর্মীর মতোই তাদের গণ্য করা হত। পুরনো নথিপত্র ঘেঁটে যানা যায় উইলিয়ম গ্লোব বা অন্য কোন থিয়েটারে অভিনয় করেননি। যদিও এ বিষয়ে মতান্তর রয়েছে।
তাঁর নাটক বহুল প্রচলিত হলেও, তিনি শুরুর দিকে খ্যাতি পেয়েছিলেন কবিতা লিখে। ১৫৯৩ খ্রিঃ 'ভেনাস ও অ্যাডোনিস' এবং ১৫৯৪ খ্রিঃ 'দ্য রেপ অব লুক্রেসি' প্রকাশিত হলে তিনি কবি হিসেবে স্বীকৃতি পান। জন ড্রাইডেন (১৬৩১- ১৭০০) তাঁর Essay of Dramatic Poesy-তে বলেছেন, “উইলিয়াম শেক্সপীয়র সব আধুনিক এবং প্রাচীন কবিদের কবি, যার আত্মশক্তির ব্যাপকতা সর্বজনবিদিত।” তাই বটে, পৃথিবীর নামীদামী অভিনেতা অভিনেত্রীরা আজও মুখিয়ে থাকেন তাঁর সৃষ্ট চরিত্রে নিজেকে উপস্থাপিত করার জন্য- এমন তাঁর সমসাময়িকতা বোধ, ইংরেজী সাহিত্যের ইতিহাস তাঁকে বাদ দিয়ে জানার প্রশ্নই ওঠে না, এমন তাঁর দূরদর্শীতা। সে যুগে নাটককে সাহিত্য বা শিল্পকর্ম হিসেবে গণ্য করা হত না বলেই পরবর্তী সময়ে তাঁর হৈচৈ ফেলে দেওয়া সমস্ত নাটক, প্রহসন কোনও কিছুরই স্বীকৃতি তিনি জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারেননি। উইলিয়মের জীবনী লেখা হয় তাঁর মৃত্যুর একশ' বছর পরে। তাঁর জীবদ্দশার অপেক্ষা আর সবকিছু না দেখে চলে যাওয়ার এই মহৎ 'ট্র্যাজেডি'টাই যেন তাঁকে আরও বেশি করে 'শেক্সপীয়র' করে তুলেছে, তিনি হয়ে উঠেছেন 'বিশ্ব ট্র্যাজেডির মহামানব'।