ব্রিটিশ পুলিশের কাছে তিনি ছিলেন ‘দ্য অগ্নি অফ ইন্ডিয়া’

ডিসেম্বরের শেষ। শীত পড়তে শুরু করেছে। লাহোরের রাস্তায় থিকথিক করছে পুলিশ। শ্যেন নজরদারি চলছে শহর জুড়ে। দিন কয়েক আগেই গুলি করে হত্যা করা হয়েছে পুলিশ অফিসার জন সাউন্ডারকে।  ঘাতকের সন্ধানে এলোপাথাড়ি ধরপাকড় চালাচ্ছে ব্রিটিশ পুলিশ। তারা চাপদাড়ি আর পাগড়ি বাঁধা এক যুবককে খুঁজছে।

দিন কয়েক পরের ঘটনা। লাহোর রেলস্টেশন তখনও খাকির ভিড়ে ছয়লাপ। সেখানেই দ্রুত বেগে হেঁটে যাচ্ছে এক অল্প বয়সী দম্পত্তি। হ্যান্ডসাম, ক্লিন শেভড, সপ্রতিভ, স্যুট- হ্যাট পরা যুবক চোখ টেনে নেবেন যে কারুর। একটু পিছনে স্ত্রী, সঙ্গে শিশুপুত্র। আরও পিছনে ভৃত্য। তাদের বেশভূষা দেখে পুলিশ ফিরেও তাকালো না দম্পতির দিকে। একদল আত্মীয় তাদের ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস কামরায় তুলে দিয়ে গেল। ভৃত্যটি লাটবহর নিয়ে থার্ড ক্লাসে গিয়ে উঠল। স্টেশন ছেড়ে ট্রেন পাড়ি দিল কানপুরের দিকে।  

 যে কোনও থ্রিলারকে হার মানাতে পারে এই দৃশ্য। কারণ পুলিশ যে চাপ দাড়ি আর পাগড়ি বাঁধা এক যুবককে ইংরেজ অফিসার হত্যার অভিযোগে খুঁজছে, সেই যুবকই  ছদ্মবেশে পুলিশের চোখের ওপর দিয়ে শহর ছাড়ল। এভাবেই।   

ইতিহাস সেই ক্লিন শেভড, স্যুট- হ্যাট পরা যুবককে চিনেছিল ভগৎ সিং নামে।  ভৃত্য রাজগুরু। আর যুবকের স্ত্রী ‘দুর্গা ভাবি’।

ভগৎ সিং আর রাজগুরু শহিদের সম্মানে মানুষের মনে চির উজ্জ্বল। কিন্তু তাঁদের সঙ্গেই সমান ঝুঁকি নিয়েছিলেন যিনি সেই ‘দুর্গা ভাবি’র খোঁজ ইতিহাস রাখেনি।

১৯০৭ সালে এলাহাবাদে এক গুজরাটি পরিবারে দুর্গাবতীর জন্ম হয়। ছোটবেলাতেই মাকে হারান। তারপর এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ার কাছে বড় হয়ে ওঠা। বাবা সন্ন্যাস নিয়েছিলেন।

মাত্র ১১ বছর বয়সে লাহোরের ন্যাশনাল কলেজের ছাত্র ভগবতী চরণ ভোরার সঙ্গে বিয়ে হয়। ন্যাশানাল কলেজেই ভগৎ সিং এবং সুকদেবের সঙ্গে আলাপ হয় ভগবতী চরণের।

নওজওয়ান ভারত সভার সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। লাহোরে বিপ্লবী কর্মকান্ডের সঙ্গেও যুক্ত।

ভগবতী একা নন,  স্ত্রী দুর্গাবতীকেও সঙ্গী করেছিলেন।পরিবারের সদস্যরা কোনও উপায়েই এই তরুণ দম্পতিকে স্বদেশী পথ থেকে সরিয়ে রাখতে পারেনি।

দুর্গাদেবী লাহোর উওমেন্স কলেজে পড়াতেন। স্বামীর সূত্রে বাড়িতে বিপ্লবীদের আসা-যাওয়া থাকলেও ছোটবেলা থেকেই প্রাধীন দেশের সমাজ ও রাজনীতি সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন তিনি।

১৯২৮ সালে পুত্রের জন্মের পর অন্তরালে চলে যেতে বাধ্য হন। হিন্দুস্থান সোশালিস্ট রেভলিউশনারি অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের ব্যাপক ধরপাকোড় শুরু করে পুলিশ।

হিন্দুস্থান সোশালিস্ট রেভলিউশনারি অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বিশের দশক পর্যন্ত। ১৯২৮ সালে তাঁরা তাঁদের একমাত্র শিশু সন্তানকে নিয়ে  লাহোরে একটি ভাড়া বারিতে থাকতে শুরু করেন। ভগবতী ভোরার পরিবার ছিল অত্যন্ত ধনী, কিন্তু তিনি নিজের আদর্শের পথে চলবেন বলে সমস্ত প্রাচুর্য ত্যাগ করেন।

১৯২৮-এ তিনি কলকাতায় আসেন কংগ্রেস পার্টির অধিবেশনে অংশগ্রহণ করার জন্য।

১৯২৮-এর ১৯ ডিসেম্বর। ভগৎ আর রাজগুরু দুর্গাবতীর কাছে এলেন লাহোর থেকে বেরতে তাঁদের সাহায্যের জন্য। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে শহর ছেড়ে। দুর্গা সাজলেন ভগতের স্ত্রী। রাজগুরু তাঁদের ভৃত্য। সেই সময়ের নিরিখে একজন বিবাহিত মহিলা অন্য পুরুষের স্ত্রী হিসেবে প্রকাশ্যে আসা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। কিন্তু ভগৎ সিং আর রাজগুরুকে বাঁচাতে নির্দ্ধিদায় তিনি এই  ঝুঁকি নিয়েছিলেন। কলকাতা চলে আসার পরামর্শও তিনিই তাঁদের দিয়েছিলেন।

ব্রিটিশ অফিসার জন সাউন্ডারই লালা লাজপত রাই- এর মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল। প্রায় ৫০০ পুলিশ অফিসার ছিল সেই ট্রেনে। গোটা সফরে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী’র ভূমিকায় অভিনয় চালিয়ে যান। আর রাজগুরু তাঁদের ভৃত্যের ভূমিকায়। কোথাও একচুল বিচ্যুতি ঘটলেই জীবন বিপন্ন। সঙ্গে তিন বছরের ছেলে।

কানপুর থেকে লখনউ। সেখান থেকে কলকাতা এসে ভগবতী চরণের সঙ্গে দেখা করলেন তাঁরা। দুর্গা শিখেছিলেন বোমা তৈরির কৌশল। বাঙালি বিপ্লবীদের সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল তাঁর।

 ১৯২৯ তে দুর্গা দিল্লিতে এলেন। আবার দেখা হল ভগৎ সিং-এর সঙ্গে।

এর কিছুদিন পরেই  ভগৎ সিং আর বটুকেশ্বর দত্ত দিল্লি লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে বোমা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটান।

নিজের সমস্ত গয়না বিক্রি করে দিয়েছিলেন ভগৎ সিং সহ অন্য বিপ্লবীদের মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে মামলা চালাবার অর্থ জোগাড়ের জন্য।

দুর্গাকে হিন্দুস্থান সোশালিস্ট রেভলিউশনারি অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত সকলেই ‘ভাবি’ নামে ডাকতেন।

ভগৎ সিং গ্রেফতার হওয়ার পর তাঁকে মুক্ত করার জন্য কারাগারে বোমা নিক্ষেপের পরিকল্পনা করেন  ভগবতী চরণ। রবি নদীর তীরে বোমা পরীক্ষা করতে গিয়ে বিস্ফোরণে ভগবতী চরণের মৃত্যু হয়।   

স্বামীর অকাল মৃত্যুতে হৃদয় ভাঙলেও বিপ্লবী কর্মকান্ডে যেন আরও বেশি করে সঁপে দিয়েছিলেন দুর্গাবতী। লাহোর জেলে আমরণ অনশনে যতীন দাসের মৃত্যুর পর লাহর থেকে কলকাতায় তাঁর শোক মিছিলের পুরোভাগে ছিলেন তিনি।  সেই বছরেই দক্ষিণ বোম্বাই-এর ল্যামিংটন রোডে এক ব্রিটিশ পুলিশকে গুলি করে হত্যা করেন। এই ঘটনা প্রথম ব্রিটিশের বিরোধী মহিলা আক্রমণ বলে বর্ণনা করে ইংরেজ সরকার।  দুর্গাকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশ রাজ পুলিশ। তিন বছরের কারাদন্ড হয়।

FotoJet - 2019-10-17T200638.844

গাজিয়াবাদে তিনি থাকতেন। আপাত বিশেষত্বহীন  এক সাধারণ বৃদ্ধা।আর পাঁচ জন নাগরিকের মতই। তার জন্য প্রস্তুতিও নিয়েছিলেন। মন্টেসরি শিক্ষা পদ্ধতির জনক মেরিয়া মন্টেসরির কাছে শিশু শিক্ষার প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ১৯৩৯ সালে। এক বছর পর লখনউ এর ‘পুরানা কিল্লা’ অঞ্চলে দুঃস্থ শিশুদের জন্য একটি স্কুল শুরু করেন। উত্তর ভারতের প্রথম মন্টেসরি স্কুল। পাঁচ জন ছাত্র নিয়ে শুরু হয়। ১৯৫৬ সালে সেই স্কুল পরিদর্শনে আসেন প্রধান মন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু।

এখন সেই স্কুলের নাম ‘সিটি মন্টেসরি স্কুল’। নিজের বসত বাটিও দান করেন ‘শহীদ শোধ সংস্থান’ নামে এক সংস্থাকে।  

১৯৯৯ সালে ৯২ বছর বয়সে লোকচক্ষুর অন্তরালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বিপ্লবী দুর্গাবতী। ব্রিটিশ পুলিশের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘দ্য অগ্নি অফ ইন্ডিয়া’ নামে।

 

 

 

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...