ছোটবেলা থেকেই চোখে চোখে রাখা হত তাদের। কড়া শাসনের শিকলে কালশিটে পরত শরীরে মনে। বাল্য বিবাহ, অকাল বৈধব্য এসব বেরিয়ে বর্ণপরিচয়ের জগতে পা রাখা বড় দুঃসাধ্য প্রাচীর।
হাজার হাজার বাধা। সে সব পার করে যদিও বা অক্ষর পরিচয়ের গন্ডি পার করা গেল নাটক-নভেল সাহিত্যের নাগাল যেন না পায়। বাংলা তথা ভারতীয় সমাজে এই ছিল মেয়েদের অবস্থান।
জ্ঞানের আলোর সন্ধানে খুব গোপনে হলেও শুরু হয়েছিল মেয়েদের সাহিত্যচর্চা। লজ্জা,ভয় সব মাথায় নিয়েও নিজের কথা কলমে প্রকাশের তাগিদ খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁরা। কলমের ভাষায় মুখর হয়ে ওঠার প্রথম মুখ স্বর্ণকুমারী দেবী। বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা ঔপন্যাসিক।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পঞ্চম কন্যা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়দিদি। ঠাকুরবাড়ির পরিসরে জ্ঞান ও পাঠ চর্চার মুক্ত আলোয় আলোকিত হয়েছিল জীবন। শুরু থেকেই। অন্দর মহলে বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্যের পাঠ শুরু হয়েছিল ছোটবেলায়।তাঁর নিজের কথায়, “আহার-বিহার-পূজা-অর্চনার ন্যায় সেকাল ও আমাদের অন্তঃপুরে লেখাপড়া মেয়েদের মধ্যে একটা নিয়মিত ক্রিয়ানুষ্ঠান ছিল।”
এক ‘বৈষ্ণবী ঠাকুরণ’ আসতেন। দেবদেবীর বর্ণনা, প্রকৃতি বর্ণনা করে শোনাতেন বাড়ির বালিকাদের। সংস্কৃত জানতেন। বাংলাতেও তেমনি দখল। তাঁর পুঁথি পাঠ আর বর্ণনার টান এমনই ছিল যে যারা পাঠে খুব ইচ্ছুক নয়, তারাও তাঁর কাছে নিয়ম করে বসত।
এক মিশনারী শিক্ষিকা আসতেন। কিন্তু তাঁর পড়ানো খুব পছন্দ না হওয়ায় নিয়ে আসা অন্য শিক্ষক। সেইপ্রথমবার ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের জন্য ঘরমহলে এক অনাত্মীয় পুরুষ প্রবেশ করলেন শিক্ষক হিসেবে। অঙ্ক, সংস্কৃত, ইতিহাস, ভূগোল এবং ইংরেজী স্কুলপাঠ্য বই পড়াতেন তিনি।
স্বর্ণকুমারী ছোট থেকেই মনোযোগী ছাত্র। মহর্ষি নিজ ও উৎসাহ দিতেন মেয়েকে পড়াশোনায়। দাদাদের থেকে পেতেন লেখার উৎসাহ। লেখার খাতায় নিজেকে মেলে ধরার অভ্যাসটা শুরু হয়েছিল সেভাবেই। ১৮৬৮-তে নদীইয়া জেলার দশমী গ্রামের জমিদারবংশীয় জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে পরিণয়ে আবদ্ধ হন। ঠাকুরবাড়ির অন্যতমা আলোকপ্রাপ্তা কন্যাটিকে বিবাহ করে তাঁর সাহিত্যচর্চার পথটি রুদ্ধ হতে দেননি তিনি, বরং হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন স্বর্ণকুমারীর জীবনে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।
তখন ব্রিটিশরাজ চলছে দেশে। নানা বিধির প্রাচীরে বদ্ধ মেয়েদের জীবন। গৃহস্থ বাড়িতে মেয়েদের পড়াশোনার বাধা ছিল অনেক। পড়াশোনা করলে ঘরের কাজে মন থাকবে না। বিয়ে হবে না, এমনি স্বামী হারা হওয়ার ভয়ও দেখানো হত। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে জানকীনাথ কিন্তু একবারে বিপরীত স্রোতে হেঁটেছিলেন। ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত হয় স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রথম উপন্যাস ‘দীপ নির্বাণ’। জাতীয়তাবাদী ভাবের ধারায় প্রভাবিত উপন্যাস। সমাজ এবং সমকালের প্রেক্ষাপটে।
এই উপন্যাস প্রকাশের আগে ১৮৫২ সালে হানা ক্যাথরিন মুলেনস তাঁর ‘ফুলমণি ও করুণার বৃত্তান্ত’ প্রকাশ করেছিলেন। বাংলা ভাষার প্রথম ঔপন্যাসিকের মর্যাদা লাভ করেছিলেন তিনি। ‘দীপ নির্বাণ’ প্রকাশিত হওয়ার পর স্বর্ণকুমারী দেবীই প্রথম বাঙালি নারী ঔপন্যাসিকের স্বীকৃতি পান। আঠারো বছর বয়সে তিনি রচনা করেন এই উপন্যাস। দীর্ঘ সাহিত্যিক জীবন তাঁর। সাহিত্যের প্রায় সমস্ত স্রোতে কলম ছুটেছে পাল তোলা গতিতে। পরবর্তী সময়ে সম্পাদক হিসেবেও সফল হয়েছিলেন। সম্পাদনা করতেন বিখ্যাত ‘ভারতী’ পত্রিকা।
১৮৭৭ সালে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকেই শুরু করেছিলেন ‘ভারতী’। পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। দ্বিজেন্দ্রনাথ সাত বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন। পরে পত্রিকার দায়িত্ব নেন স্বর্ণকুমারী। এগারো বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেন। পত্রিকা যাতে সব দিক থেকে অন্যরকম হয়ে ওঠে সেদিকে কড়া নজর ছিল তাঁর। কঠোর পরিশ্রম করতেন ‘ভারতী’কে সফল করে তুলতে।
পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হত। ভাষাও ছিল সময়ের থেকেই অনেকটা আলাদা। সহজ সরল। যাতে সব ধরনের মানুষ পত্রিকার ব্যাপারে উৎসাহী হয়, তার জন্য এই প্রয়াস। সাহিত্য সমালোচকমহলেও প্রশংসিত হয়েছিল। উত্তরকালে স্বর্ণকুমারী দেবীর কন্যারা বারো বছর ও রবীন্দ্রনাথ এক বছর এই পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন।
স্বর্ণকুমারীর গীতিকাব্যের ধারাকে পরবর্তী সময়ে গ্রহণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেই ধারাকে আরও শানিত করেছিলেন তিনি।সাহিত্য থেকে রাজনীতি এমন সপ্রতিভ চলন সেই সময়ের নিরিখে বিরল। মেয়েদের কলমকে মুক্তি দিয়েছিলেন তিনি। তারপর অনেক নাম, অনেক মুখ। শত সহস্র ফুলের সৌরভে মুক্ত আজ বাংলায় মহিলা সাহিত্য। স্বর্ণকুমারী দেবী থেকে ঝুম্পা লাহিড়ি- সেই ট্র্যাডিশন আজও চলছে...