শ্রাবণ মাসে শিবের মাথায় জল ঢালার অনেক গল্প ও অনেক কাহিনি। সে-সব হয় জনশ্রুতি, নয় পুরাণের নামে গোঁজামিল।
এক মতে, শ্রাবণ মাসেই নাকি দেবতা ও অসুরদের সম্মিলিত প্রয়াসে সমুদ্রমন্থন হয়েছিল। সেই মন্থনে সমুদ্র থেকে অমৃতের কলস ওঠার আগে উঠেছিল তীব্র হলাহল অর্থাৎ বিষ।
সেই বিষ এতটাই তীব্র ছিল যে, তা সমস্ত সৃষ্টিকে নষ্ট করে ফেলার ক্ষমতা রাখত। সৃষ্টিকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসছিলেন শিব। তিনি সেই বিষ কণ্ঠে ধারণ করে 'নীলকণ্ঠ' হয়েছিলেন। বিষ জনিত বিঘ্ন নাশ করেছিলেন।
বিঘ্ননাশা শিবকে তাই এই শ্রাবণ মাসে বিশেষভাবে অর্চনা করা হয়। শিব যেমন নিজে বিষ ধারনের জ্বালা সয়ে জীব ও জগতকে রক্ষা করেছেন, তাই শিবের ভক্তরাও পায়ে হেঁটে কাঁধে বাঁক নিয়ে কৃচ্ছ্রসাধনার মধ্য দিয়ে পুণ্যসলিলে তাঁকে বিশেষভাবে অবগাহন করিয়ে পুজো করেন। শীতল জল শিবের অঙ্গে ঢেলে বিষ-জ্বালা সাময়িকভাবে প্রশমণের প্রয়াস করেন।
এদিক থেকে শ্রাবণ মাসে শিবের অঙ্গে জল ঢালা আসলে একদিকে শিবের কল্যাণকর্মের স্মৃতি অনুষ্ঠান এবং তাঁর প্রতি মানুষের কৃতজ্ঞতার প্রকাশ বলা যায়। অনুষ্ঠানটি একটি সুনীতির কথাও বলে, সেটি হচ্ছেঃ কেউ যদি তোমার জন্য বড় রকমের স্বার্থ ত্যাগ করেন, তুমি অন্তত তোমার সাধ্যমতো ছোট ছোট ত্যাগের মধ্য দিয়ে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।
আবার অন্য মতে, শ্রাবণ মাসে নাকি পার্বতীর সঙ্গে শিবের বিয়ে হয়েছিল।
এই মতটিকে গুরুত্ব দিলেও বলতে হয় যে, শ্রাবণ মাসে শিবের মাথায় জল ঢালার যে অনুষ্ঠান, তা আসলেই স্মৃতি-অনুষ্ঠান। এই যে বিশেষ ঝর্না বা নদী থেকে কলসি ভরে জল আনেন ভক্তেরা, বাঁকে-মাথায় বা কাঁখালে-এ-আসলে বিবাহের আগে জল সইতে যাওয়া অনুষ্ঠানেরই পুনরাভিনয়। কারণ, এ-সময় তাঁরা সেই বয়ে আনা জল দিয়েই বর-কনে মহেশ্বর ও উমাকে মনের মতো করে স্নান করিয়ে দেন।
এখন প্রশ্ন হল, বর শিবের মাথাতেই তো ভক্তেরা জল ঢালেন আমরা দেখে থাকি, সেখানে কনে উমা কোথায়?
শাস্ত্র মতে, কনে উমা হপ্তায় একদিন শিবের সঙ্গে অবস্থান করেন, প্রতি সোম বার। 'সোম' কথার মানেই হল, 'উমার সঙ্গে শিবের অবস্থান'।
সোম বারটিকেই তাই শিবের মাথায় জল ঢালা অর্থাৎ শিবকে স্নান করানোর প্রশস্ত দিন বলে ধার্য করা হয়েছে। আর এ-কথা মাথায় রেখেই ফি-বৎসর শ্রাবণ মাসে ভক্তেরা এ-দিন শিব-পার্বতীকে একই সঙ্গে স্নান করিয়ে যেমন পুণ্য অর্জনের চেষ্টা করেন, তেমনি পৌরাণিককালে সংঘটিত শিব-পার্বতীর বিয়ের বার্ষিকীও পালন করেন।
এবার আসি বেদ প্রসঙ্গে।
বেদে শিবের নাম 'রুদ্র'। তিনি সেখানে বজ্রের দেবতা। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর মেঘবৃষ্টি প্রভৃতিও তাঁর অধীনেই ছিল।
বেদের যুগে বেদ-শিক্ষিত ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় সমাজের বাইরে যে বৃহৎ জনগোষ্ঠী, তাঁদের কাছেও মেঘবৃষ্টিবজ্রের দেবতা হিসেবে ওই দুই শ্রেণির হাত ধরে মহাদেব পৌঁছে গেলেন। বেদের প্রকৃতি ও নিরাকার সাধনা লোকসাধারণের আর ভালো লাগছিল না। তাঁরা কল্পনার দেবতাকে চাক্ষুষ করতে চাইলেন।
লোকসাধারণের ইচ্ছেতেই কল্পনার দেবতারা পার্থিব রূপ পেলেন। আসলে বাস্তব অভিজ্ঞতায় তাঁরা প্রায়শই দেখেছেন পাহাড় আর পর্বতের শৃঙ্গের দিকে মেঘমণ্ডলকে ধেয়ে আসতে। দেখেছেন, শৃঙ্গের গা ছুঁয়ে মেঘমালাকে বৃষ্টিরূপে ঝরে পড়তে। দেখতে দেখতেই তাঁদের মনে হয়েছে যে, পাহাড় বা পর্বতই আসলে সেই মুনি কথিত মন্ত্রোক্ত বৃষ্টির দেবতা, যিনি মেঘেদের টেনে এনে বৃষ্টিপাত ঘটান। ক্রমে এভাবেই একদিন শুরু হল ‘রুদ্র’ হিসেবে পাহাড় বা পর্বতের পুজো।
মানুষের ইচ্ছে বড় বিচিত্র আবেগময়। সেই আবেগে ভর করেই একসময় তাঁরা প্রাণের এই দেবতাকে আপনজনের মতো ঘরে ঠাঁই দিতে চাইলেন। যাতে, যখনই মন চাইবে পুজো করা যায়। কিন্তু মুশকিল হল, পাহাড়-পর্বত তুলে তো আর ঘরে আনা যায় না। তাহলে, উপায়?
তখন অনেক ভেবেচিন্তে পাহাড় আকৃতির পাথর দিয়ে তৈরি করা হল 'রুদ্র' দেবতার ক্ষুদ্র সংস্করণ, যাঁকে সহজেই ঘরে অধিষ্ঠিত করা যায়। এটিই হল রুদ্র অর্থাৎ শিবের আদিম প্রতিমা। তাঁর এই আদিমস্বরূপটি এখনো বজায় আছে বলেই, তাঁকে 'আদি দেবতা' বলা হয়।
পৌরাণিক যুগে এই 'আদি দেবতা' শব্দবন্ধটিকে গুরুত্ব দিয়ে তৈরি হয়ে গেল সৃষ্টির আদিতে অনন্ত শিবের উপস্থিতির উপাখ্যান।
যাই হোক, সেই ব্যাপক প্রকৃতি-নির্ভরতার যুগে বর্ষার মরসুমে প্রকৃতির খামখেয়ালে সঠিক সময়ে বৃষ্টি না-হলে, মানুষের হয়তো মনে হত যে, শিবরুদ্র নিশ্চয়ই হাজার কাজের মাঝে বৃষ্টি আনতে ভুলে গেছেন।
তাই সম্ভবত সেই সময় পাহাড়রূপী শিবের মাথায় বারিপাতের মধ্য দিয়ে তাঁকে তাঁর কর্তব্য স্মরণ করানোর একটি ঐতিহ্যের জন্ম হয়। সেই ঐতিহ্যের মধ্যেই হয়তো আজকের এই শ্রাবণের কৃষিকালে শিবের মাথায় জল ঢালার আদি সূত্রটি লুকিয়ে আছে।
প্রসঙ্গত বলি যে, এই পৌরাণিক যুগেই শিবের পাহাড়রূপটিকে লিঙ্গরূপ হিসেবে তুলে ধরা হল। বৃষ্টি ও সৃষ্টিকে প্রজননের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করা হল তত্ত্ব। শিবের থানে ভিড় বাড়ল বিবাহ-উন্মুখ কুমারী আর সন্তানকামী নারীদের।
যাই হোক, শিবের মাথায় জল ঢালা রীতিটির উদ্ভবের মূলে আর একটি সম্ভাবনা হচ্ছে, জাদু-সংস্কার।
জাদু-সংস্কার আদিম লোকবিশ্বাসের ব্যাপার। এই বিশ্বাসে ধরে নেওয়া হয় যে, প্রকৃতির কর্মকাণ্ডের প্রতীকায়িত অভিনয় করলে প্রকৃতি তাতে সাড়া দেয়। এই যেমন, মেঘের প্রতীক কলসি থেকে পাহাড়-প্রতীক পাথরে জল ঢাললে প্রকৃতি তার অনুকরণে অবিলম্বে বৃষ্টিপাত ঘটাবে। এই পুরো ব্যাপারটিই হয়তো সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে দেব এবং ধর্মভাবনার বিবর্তনে পাহাড়-পর্বত ও শিব একাত্ম হয়ে ওঠার কোন এক লগ্নে শুধুই শিবের মাথায় জল ঢালার ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে।