শুধুমাত্র রসিকতার জেরে যে এক পরিবার সমাজে পতিত হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বিস্মৃত হতে বাধ্য হয়, তার কথাই আজ বলবো। আবার এই পরিবারের উত্তরসূরী এমন এক ব্যক্তি যিনি শুধু বিশ্ব বরেণ্যই নন, এক প্রতিষ্ঠানও বটে। সেই ইতিহাস বলবো।
বলছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারের কথা। মানে তার এই ‘ঠাকুর’ পদবী সম্পর্কে। কারণ তাঁর প্রকৃত পদবী ছিল কিন্তু ‘কুশারী’। তাহলে হঠাৎ ‘ঠাকুর’ ব্যবহারের কারণ কি! এই কুশারী থেকে ঠাকুর হওয়ার ব্যাখ্যা দিতে গেলে তাঁর পূর্বপুরুষদের কথা জানা প্রয়োজন, কারণ ঘটনার সূত্রপাত সেখান থেকেই।
রবীন্দ্রনাথের মাতুলকুল অতি তুচ্ছ রসিকতার জেরে এক শ্রেণীর পতিত ব্রাহ্মণ- পিরালী ব্রাহ্মণে পরিণত হয়েছিলেন। রঘুনাথ আচার্য ছিলেন যশোরের চেঙ্গুটিয়া পরগনার জমিদার। সেই সময় খান জাহান আলি সেই পরগনার কর্তৃত্ব লাভ করেন, তাঁর সঙ্গে আসেন তাহের খাঁ নামের এক ব্যক্তি, নবদ্বীপের পিরল্যা গ্রামে কিছুদিন বসবাসের কারণে তিনি ‘পিরল্যা খাঁ’ নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন ধর্মান্তরিত মুসলমান, কথিত আছে যে, তাহের খাঁ রোজা চলাকালীন একটি লেবুর ঘ্রাণ নিয়েছিলেন। তখন জমিদার রঘুনাথ আচার্যের প্রপৌত্র কামদেব ঘ্রাণে অর্ধভোজন — এই প্রবাদ ব্যবহার করে তার সঙ্গে রোজা নষ্ট হয়ে যাওয়া নিয়ে রসিকতা করেন। এরই সূত্র ধরে জয়দেব আর কামদেবকে গোমাংসের গন্ধ এবং স্বাদ অনুভব করিয়ে তাঁদের সমাজে পতিত করা হয়। ঘোষণা করে দেওয়া হয়, কামদেব আর জয়দেব নাকি এই পদ্ধতিতেই ধর্মান্তরিত হয়েছেন। তাদের নাম হয় কামাল খাঁ আর জামাল খাঁ । গোঁড়া হিন্দু সমাজ সুযোগ পেয়ে শুধু কামদেব-জয়দেবকে নয়, তাদের আত্মীয় স্বজন সকলকেই ‘পিরালী ব্রাহ্মণ’ আখ্যা দিয়েছিল। ‘পির’ অর্থাৎ মুসলমান সংসর্গ হয়েছিল বলে ‘পিরালী ব্রাহ্মণ’! এই হলো প্রাথমিক সূত্রপাত।
কামদেব আর জয়দেবের ভাই শুকদেব সমাজের অত্যাচারে ঘর ছাড়তে বাধ্য হন। এই শুকদেবের মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন পিঠা ভোগের জমিদার জগন্নাথ কুশারী- ঠাকুর গোষ্ঠীর আদিপুরুষ। স্বাভাবিকভাবেই তিনিও সমাজের রোষানলে পড়েন।
কথিত আছে জগন্নাথের দ্বিতীয় পুত্র পুরুষোত্তম এক মুসলিম রাজকুমারীকে বিয়ে করে সমাজে আবার পতিত হন। এই পুরুষোত্তমের প্রপৌত্র ছিলেন রামানন্দ। তাঁর উত্তরসূরীরা কলকাতার দক্ষিণে গোবিন্দপুরে এসে থাকতে শুরু করেন। এই সময় ইংরেজদের বাণিজ্য তরী এসে ভিড়ত গোবিন্দপুরের গঙ্গায়। কুশারীদের উত্তর পুরুষ পঞ্চানন কুশারী সেই সময় স্থানীয় মানুষদের নিয়ে ইংরেজ ক্যাপ্টেনদের খাদ্য সামগ্রী, জল সরবরাহের কাজ করতেন। ব্রাহ্মণ সন্তান বলে, তারা পঞ্চানন কুশারীকে ‘ঠাকুরমশাই’ বলে ডাকতেন। সেই থেকে ধীরে ধীরে ‘কুশারী’ পদবী হারিয়ে গেল। যদিও গৃহদেবতা হিসেবে প্রথমে শিব পরবর্তীকালে শ্রীরাধাকান্ত জিউ প্রতিষ্ঠা তাঁদের পৌত্তলিক পরিচয়টিই স্পষ্ট করে। কিন্তু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই চিরাচরিত ধর্মের মূলে কুঠারাঘাত করেন। আর ‘কুশারী’ পদবি বিস্মৃত হয়ে ‘ঠাকুর’ হিসেবেই এক অনন্য পরিচয় সৃষ্টি হলো এই পরিবারের।