সবে আদি কল্পের শুরু। স্বর্গ-মর্ত-পাতাল জুড়ে মহাদেব তখন কেবলই একা। সেই অবসরে মন চাইল স্রষ্টা হতে। সৃষ্টি করলেন বিষ্ণু এবং ব্রহ্মাকে। নিজের হাতে সংহারের সূত্র রেখে ব্রহ্মা ও বিষ্ণুকে দিলেন যথাক্রমে প্রজা-সৃষ্টি ও পালনের ভার। তখনও নারীর সৃষ্টি হয়নি, তাই প্রজা-সৃষ্টিতে ব্রহ্মার একমাত্র অবলম্বণ হল, আপন মনের কল্পনা। প্রথমেই সৃষ্টি করলেন স্বর্গ-মর্ত-পাতাল--এই তিন লোকের অধিকারী পুত্র : দেবতা, মানব এবং দানব। মন থেকে জন্ম নিলেন বলে এঁরা হলেন, ব্রহ্মার মানসপুত্র। সন্তানের জন্ম যখন দিয়েছেন, তখন পিতা হিসেবে তাদের ব্রহ্ম-শিক্ষার ব্যবস্থাও তো করতে হবে। কিন্তু, সেই আদি কালে শিক্ষক কোথায়? কাজেই নিরুপায় হয়ে ব্রহ্মা নিজেই তাদের শিক্ষার ভার নিলেন। ব্রহ্মলোকে প্রথমে ব্রহ্মচর্যে দীক্ষা দিলেন। তারপর শুরু হল শিক্ষাদান।
বহুবছর পর একদিন শিক্ষা সম্পূর্ণ হল। পুত্ররা আত্মজ্ঞান লাভ করলেন। পিতার কাছে বিদায় নিয়ে এবার দেবতারা স্বর্গে ফিরবেন, মানবেরা ফিরবেন মর্তে আর দানবেরা যাবেন পাতালে। বিদায় নেবার সময় প্রথমে দেবতারা গিয়ে পিতাকে প্রণাম করলেন। হাতজোড় করে বললেন, 'পিতা, দয়া করে পাথেয় হিসেবে কিছু উপদেশ দিন!' দেবতাদের প্রার্থনা শুনে ব্রহ্মা অত্যন্ত খুশি হলেন, উচ্চারণ করলেন, ‘দ’। বললেন, ‘পুত্র এই আমার উপদেশ, এর মধ্য দিয়ে আমি কি বলতে চাইছি তোমরা বুঝেছ তো?’
দেবতারা দারুণ উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ‘হ্যাঁ পিতা, আপনি আমাদের ‘দান্ত’ অর্থাৎ শাসন করার কথা বললেন।’দেবতারা স্বভাবে সৌম্য, দয়াবান এবং দুর্দমনীয়। তাই একমাত্র তাঁরাই জগৎ-সংসার শাসন করতে পারেন। ব্রহ্মচর্যের শিক্ষা নিতে গিয়ে দেবতা, মানব, দানব—সকলেই নিজের নিজের দোষগুণ সম্পর্কে অবহিত হয়েছিলেন। তাই, দেবতারা ‘দ’ শব্দের ‘দান্ত’ অর্থ করলেন দেখে, ব্রহ্মা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন। দেবতাদের পর মানবেরা ব্রহ্মাকে প্রণাম করলেন। অনুনয় করে বললেন, ‘হে পিতা, দয়া করে আপনি আমাদেরও উপদেশ দিন!’ ব্রহ্মা খুশি হয়ে এবারও উচ্চারণ করলেন, ‘দ'। বললেন, ‘পুত্র এই আমার উপদেশ, এর অর্থ বুঝেছ তো?’
‘বুঝেছি পিতা, আপনি আমাদের ‘দত্ত’ অর্থাৎ দান করার কথা বলছেন।’ মানবেরা স্বভাবে লোভী এবং কৃপণ। তাই তাঁরা ‘দ’ শব্দের ‘দান’ অর্থ করলেন দেখে, ব্রহ্মা খুব আনন্দিত হলেন। শেষে প্রণাম করলেন দানবেরা। তাঁরাও আকুতি করে বললেন, ‘হে পিতা, দয়া করে আপনি আমাদেরও কিছু উপদেশ দিন!’ ব্রহ্মা প্রসন্ন হয়ে আবারও উচ্চারণ করলেন, ‘দ’। বললেন, ‘পুত্র এই আমার উপদেশ, এর অর্থ বুঝেছ তো?’ ‘বুঝেছি পিতা, আপনি আমাদের ‘দয়ধ্বম’ অর্থাৎ দয়া করার কথা বলছেন।’ স্বভাবে হিংস্র দানবেরা ‘দ’ শব্দের ‘দয়া’ অর্থ করলেন দেখে, ব্রহ্মা যার পর নাই আহ্লাদিত হলেন। পুত্ররা এভাবে অনুগৃহিত হয়ে যে যার লোকে চলে গেলেন।
পুত্রেরা চলে গেলে ব্রহ্মার মনে অদ্ভুত এক সংশয় এলো। মনে হলো : আচ্ছা, তিনি যে এই মঙ্গলময়-উপদেশ তাঁর পুত্রদের দিলেন, এ কি তাঁরা মোহের বশে সময়কালে মনে রাখবেন? তাঁদের সন্তানসন্ততিরাই বা এই উপদেশের কথা কেমন করে জানবেন! এ-কথা ভেবেই বুকের ভেতর থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ব্রহ্মার। পুত্রদের মঙ্গলভাবনায় তিনি মুহ্যমান হয়ে পড়লেন। এই সময় সেখান দিয়ে মেঘ যাচ্ছিল দারুণ ব্যস্ত হয়ে। সে ব্রহ্মাকে অমন মুহ্যমান হয়ে থাকতে দেখে থমকে গেল। জিজ্ঞেস করলো কারণ। ব্রহ্মার কাছে কারণটি জেনে এক গাল হেসে মেঘ বলল, 'চিন্তা কীসের পরম পিতা! আমি যতদিন বিরাজিত আছি, আপনার মঙ্গলময় তিন উপদেশ আপনার পুত্র এবং তাদের সন্তানসন্ততিদের মনে করিয়ে দেওয়ার সব দায় আমার। এবার আপনি প্রসন্ন হোন!' মেঘের আশ্বাসে ব্রহ্মা এবার সত্যিই প্রসন্ন হলেন।
আর সেই থেকেই আকাশজুড়ে শুরু হল মেঘের হাঁকডাক, যা আজও চলছে। আর এই হাঁকডাকের মধ্যেই রয়েছে ব্রহ্মার তিনটি উপদেশ, ‘দ, দ, দ—দান্ত, দত্ত, দয়ধ্বম!’ কল্পনাপ্রবণ মন নিয়ে জগদীশচন্দ্র বসু যেমন গঙ্গা নদীর কাছে শুনেছিলেন 'শিবের জটা থেকে' আসার কথা; সেই মন নিয়ে শুনলে মেঘের ডাকে হয়তো ব্রহ্মার ওই তিন উপদেশ আজও শোনা যেতে পারে!
গল্পের উৎস : বৃহদারণ্যক উপনিষদ।