ঋষিরা গঙ্গার যে রূপকল্পনা করেছেন, তাতে দেখা যায়, তাঁর গায়ের রঙ হলুদ অর্থাৎ তিনি কাঞ্চনবর্ণা। তাঁর চারটি হাত, তিনি মকরবাহনা। গঙ্গা যেমন পবিত্র একটি নদীর নাম, তেমনি তা নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নামও।
হিন্দুধর্মের প্রাচীনতম গ্রন্থ 'ঋক' বেদে নদীরূপে ও দেবীরূপে গঙ্গার নাম উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও 'শতপথ ব্রাহ্মণ' ও 'কাত্যায়ন শ্রৌতসূত্র'-এর মতো বৈদিক গ্রন্থে গঙ্গার উল্লেখ আছে। তবে, গঙ্গাকে নিয়ে গল্পগাথার উদ্ভব হয়েছে কিন্তু রামায়ণ ও পুরাণের যুগে।
'বিষ্ণু পুরাণ'-এ কল্পনা করা হয়েছে, ধ্রুবতারাকে মাঝখানে রেখে যে নক্ষত্রমালা রয়েছে, তাদের মেঘপুঞ্জ নাকি বিষ্ণুর তৃতীয় পা। কোন এক কালে যেদিন সেই পা বা মেঘ ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ল হিমালয়ের মাথায়, সেদিন ছিল 'অক্ষয় তৃতীয়া' তিথি। তারপর সেই ধারাপাত স্রোতের আকার নিয়ে যেদিন পৃথিবীর বুকে এসে পৌঁছল, সেদিন ছিল 'দশহরা'।
'ব্রহ্ম পুরাণ'-এও গঙ্গার মর্ত্যে নেমে আসার পূর্বোক্ত দিনক্ষণ সব ঠিক আছে, তবে উৎপত্তির কথায় একটু রকমফের আছে। সেখানে বলা হচ্ছে যে, একবার নারদের মুখে নিজের নামসংকীর্ত্তন শুনে বিষ্ণুর সমস্ত শরীর আনন্দে রোমাঞ্চিত হল এবং তখন তাঁর পা বেয়ে প্রবাহিত হতে লাগল আনন্দময় ঘামের স্রোত। ব্রহ্মা সেই স্রোতধারা তাঁর কমণ্ডলুতে ধারণ করলেন। স্রোতধারাটির নাম দিলেন, 'গঙ্গা'। ‘গঙ্গা’-শব্দের মানে 'যা গমন করে'। পৌরাণিক ঋষিরা এর মানে করেছেন, 'যে পবিত্র জলপ্রবাহে অবগাহন করলে ব্রহ্মপদের দিকে গমন করা যায়'। তাঁদের ধারণা, যেহেতু এই জল আসলে বিষ্ণুর পা ধোওয়া স্বেদজল, তাই তা সমস্ত পাপনাশ করে জীবকে মুক্তিদান করে। পুরাণকার ব্যাসদেব এই মোক্ষকল্পনার সঙ্গেই এখানে জুড়ে দিয়েছেন ভগীরথের গঙ্গা আবাহনের কাহিনি।
‘ব্রহ্ম পুরাণ’-এর কাহিনীটি বেশ জটিল। 'মহাভারত'-এ বিস্তারিত আছে। সেটাই একটু সহজ করে এখানে বলার চেষ্টা করছি। সগর নামের এক রাজা একবার অশ্বমেধ যজ্ঞ করছিলেন। এই যজ্ঞ সফল হলেই তিনি স্বর্গের অধিপতি হবার ক্ষমতা পেয়ে যাবেন। ফলে, ইন্দ্র বেজায় ভয় পেয়ে গেলেন। তাই তিনি কোন সুযোগ দিতে চাইলেন না, সঙ্গে সঙ্গে একটা বিভ্রান্তি ঘটিয়ে যজ্ঞটাকে পণ্ড করবার এক মারাত্মক ষড়যন্ত্র কষে ফেললেন।
যজ্ঞের ঘোড়া পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে এলে তাকে বলি দিলে তবেই অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পূর্ণ হয়। নইলে নয়। তাই সগর তাঁর ষাট হাজার ছেলেকে দায়িত্ব দিলেন সেই ঘোড়ার ওপর নজর রাখার। তবুও ছলনার কলকাঠি নেড়ে ইন্দ্র তাদের কাছ থেকে ঘোড়াটিকে চুরি করে কপিলমুনির আশ্রমে এনে বেঁধে দিলেন। ঘোড়া হারিয়ে সগরের তো বটেই, ষাট হাজার ছেলেরও চোখে সর্ষে ফুল দেখার অবস্থা হল! তক্ষুনি শুরু হল আঁতিপাঁতি করে খোঁজ। খুঁজতে খুঁজতে সদলে তারা কপিলমুনির আশ্রমে হাজির হল।
আশ্রমের আস্তাবলে ঘোড়াটিকে দেখতে পেয়ে স্বাভাবিকভাবেই তারা কপিলমুনিকে চোর ঠাউরে বসল। অবশ্য সেটুকুতেই থেমে না-থেকে তারা গেল চোরকে বেঁধে আনতে। আর তখনই বাঁধল বিপত্তি। কারণ, কপিলমুনি তো এসবের বিন্দুবিসর্গও জানতেন না, বেচারা ছিলেন ধ্যানে মগ্ন; সেই অবস্থাতেই ষাট হাজার বেকুব তাঁকে ধ্যানের আসন থেকে গেল টেনে হিঁচড়ে তুলে আনতে। ব্যস, অসময়ে তাঁর ধ্যান গেল ভেঙে! অমনি অসম্ভব রেগে গিয়ে তিনি চরম অভিশাপ দিয়ে সগরের সেই ষাট হাজার পুত্রকেই একসঙ্গে ভস্ম করে দিলেন।
তখন সগর মহাশোকে মনস্তাপ করতে করতে মৃত ছেলেদের মুক্তির অনুনয় নিয়ে এসে পায়ে পড়লেন মুনির। তাতে মুনি খানিক শান্ত হয়ে নিদান দিলেন যে, বংশের কেউ যদি গঙ্গার জলে এই ষাট হাজার পুত্রের ভস্ম বা ছাই ভাসিয়ে দিতে পারে তবেই এই ছেলেদের মুক্তি হবে। অবশ্য তার জন্য মর্তে আনতে হবে গঙ্গাকে। সগরবংশে পুরুষানুক্রমে চেষ্টা চলল গঙ্গাকে মর্তে আনার জন্য। কিন্তু, সবাই যখন ব্যর্থ হল তখন এল ভগীরথের পালা।
'মহাভারত'-এর এই ধরতাইটা নিয়ে চলুন আবার ফিরে যাই 'ব্রহ্ম পুরাণ'-এ। সেখানে ভগীরথ বহুবছরের তপস্যায় ব্রহ্মাকে তুষ্ট করলেন। ব্রহ্মার কমণ্ডলুতে সঞ্চিত গঙ্গার ধারা তখন বন্ধনমুক্ত হয়ে ঝরতে লাগল হিমালয়ের মাথায়। সেটা বৈশাখের অক্ষয় তৃতীয়া তিথি। তার এক মাস পর ভগীরথের প্রার্থনায় দশহরা তিথিতে হিমালয় থেকে গঙ্গার ধারা নেমে এল সমতলে। সমতলের ওপর দিয়ে বইতে বইতে পৌষ সংক্রান্তির দিন গঙ্গার সেই ধারা কপিলমুনির আশ্রমের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সগরের ষাট হাজার ছেলের ভস্ম ছুঁয়ে তাদের মুক্তি দিয়ে শেষে বঙ্গ-উপসাগরে এসে মিশল।
এই মিলনস্থানই হল মুক্তিতীর্থ 'সাগরসঙ্গম', যার অপর নাম 'গঙ্গাসাগর'। সংক্রান্তির দিন এখানে মিশতে মিশতে গঙ্গা যেমন কমণ্ডলুর বদ্ধতা ছেড়ে নিজের মুক্তির বার্তা দিলেন, তেমনি সগরের ছেলেদের উদ্ধারের সাথে সাথে জগতের সমস্ত পাপীতাপী ও মোক্ষকামীদের পাপহরণ ও মুক্তির বার্তাও ছড়িয়ে দিলেন। সেই জন্যই মকর সংক্রান্তির দিন গঙ্গাসাগরে স্নান-অবগাহনের জন্য দেশের নানান প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন অসংখ্য মানুষ, আকুল হয়ে গঙ্গাদেবীর কাছে চেয়ে নেন মোক্ষপথের পাথেয়।