টুসুব্রতের উৎসগাথা

টুসুদের দেশে সেবার মহুয়ার বন ফুলে ফুলে সাদা। টুপ টুপ করে শেষ শীতের শিশির ছুঁয়ে তারা ঝরে পড়ছিল ভোরের ঘাসে। টুসু কুরমীদের মেয়ে। রাত পোয়ালেই তার বিয়ে। তাই তার মনের জমিনেও তখন শিশিরের শব্দবুক জুড়ে স্বপ্নের ঢেউ। কিন্তু, সেই স্বপ্ন ছিঁড়েখুঁড়ে হঠাৎ বাড়িতে ডাকাত পড়ল। লুঠেরার দল লুটেপুটে নিল টাকাকড়ি গয়নাগাঁটি স-ব। সেইসঙ্গে তাকেও। ভোগের সময়, নারীও ‘সম্পদ’ হয়ে যায় যে! তাই লুঠের সম্পদ জেনে তারা তাকেও নিল সঙ্গে। 

শেষমেশ ছলে-কৌশলে সঙ্গ ছাড়িয়ে গাঁয়ে ফিরেছিল টুসু। কিন্তু ভুক্ত মেয়েকে সমাজের মাথারা ঘরে ফিরতে দিল না। সেকেলে মেয়ে টুসু, আর পথ খুঁজে পেল না। তার কাছে তখন পড়ে ছিল একটাই পথ। সে-পথ গিয়েছিল গহীন জলের গহনে

অভাগির মরন হল। তার অমন মরন দেখে মায়েদের চোখ ফুটল। বুক ফাটল। মনে হল, এ কী গো! এ কী করলাম! ও যদি আমার মেয়ে হত! তাহলে! এমনি করে পারতাম তাকে দূরে ঠেলে দিতে! এত সহজে কি দিতাম তাকে মরতে

আগুন জ্বলল মায়েদের মনে। পুরুষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আগুন। তাদের চোখে চোখ রেখে টুসুর স্মরণ শুরু করলেন মায়েরা রচনা করলেন গান। মায়ের ভাষায় রচিত হল নতুন দিনের নারীমঙ্গল মায়েরা পুরুষদের বুঝিয়ে দিলেনঃ শোন, তোমাদের অন্যায়ে সমাজে যার জায়গা হল না, সে আমাদের মেয়ে, সে আমাদের দেবী টুসু। তার মতো করে মরতে আর কাউকে দেব না তোমাদের হাতে। চিরকাল তোমাদের চোখে জাগিয়ে রাখব তোমাদেরই অন্যায়ের স্মৃতি!

সেই থেকে মেয়ে হয়েও টুসু হল দেবী। মায়েরা হলেন পূজারিণী। মায়েদের লেখা টুসুর গান হল, টুসু-ভজনার মন্ত্র। গানের ছত্রে ছত্রে উঠে এল মেয়ের আকুলতা, মায়ের নাড়ির টান—

‘ঠায় ফাগুনে রইলাম বসে 

আর আমাদের কে আছে,

মা রইল দূরান দেশে 

প্রাণ জুড়াব কার কাছে!’

 

প্রাকৃত মা ও মেয়ের সম্পর্ক একদিন প্রতীক পেল। ‘মা’ হলেন ‘মাটি’, ‘শস্য’ হল ‘কন্যা’। কন্যা টুসু হয়ে উঠল টাঁড়বাংলার শস্যের দেবী। 

বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার লোকগাথায় আর এক মূর্তিমতী লৌকিক দেবী আছেন। ভাদু। তিনি রাজার মেয়ে। কিন্তু, টুসু হল তথাকথিত অন্ত্যজ কুর্মীর মেয়ে তবুও সে পায় সমাজের উঁচু থেকে নীচু, সমস্ত সম্প্রদায়ের মানুষীর পুজো টুসুর এও এক মাহাত্ম্য, তুষের সরার সামনে আর রঙিন চৌঢলের ছায়ায় কেমন করে যেন সে বর্ণে বর্ণে মিল ঘটিয়ে দিয়েছে সবার অজান্তেই নত করেছে পুরুষকেও।

দেশের মানুষ যখন আজ গঙ্গা আর গঙ্গাসাগরের জলে ডুবকি দিয়ে পুণ্য ছুঁতে ব্যস্ত, অন্যদিকে তখন রাঢ়-বাংলার সুদূর প্রান্তে এক মাসের টুসু ব্রত শেষে মেয়েপুরুষেরা টুসুর স্মৃতিতে জলে চৌঢল ভাসিয়ে উদযাপন করছেন নারীর মঙ্গলের জয়গাথা


ঋণঃ পুরুলিয়ার মানুষের মুখে মুখে টুসুকে নিয়ে অনেক লোকগাথা তারই একটি এ-লেখার অবলম্বন।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...