দেবাদিদেব মহাদেব অল্পতেই সন্তুষ্ট। বৈষ্ণব শাস্ত্রে বলা হয়, তিনি ভগবান শ্রীবিষ্ণুর নাম সর্বক্ষণ ধ্যান করেন তাই তিনি পরম বৈষ্ণব। তাঁর পুজো করলে সকল অভিষ্ঠ সিদ্ধি হয়। দেবাদিদেব মহাদেবের অনেক মাহাত্ম্য কাহিনী আপনারা শুনেছেন আজ আমি আপনাদের বলবো চন্দ্র দেবের ক্ষয় রোগ ও শিবের পুজো করে তার রোগ মুক্তির উপাখ্যান।
শিব পুরাণের জ্ঞান সংহিতার ত্রয়োবিংশ অধ্যায়ে জ্যোতির্লিঙ্গের মাহাত্ম্য কথা বলবার প্রসঙ্গে চন্দ্রদেবের উপাখ্যান উঠে এসেছিল। চলুন জেনে নিই সেই উপাখ্যান।
দক্ষ রাজার ২৭ জন কন্যাকে দক্ষরাজ চন্দ্রদেবের নিকট সম্প্রদান করেছিলেন। সেই সকল কন্যারা সকলেই চন্দ্র দেবকে নিজেদের স্বামী রূপে গ্রহণ করে তাদের দাম্পত্য জীবন শুরু করেন। কিন্তু চন্দ্রদেবের আচরণের মধ্যে পক্ষপাত লক্ষ্য করা গেল। এই সকল স্ত্রীদের মধ্যে তিনি রোহিণীকে সব থেকে বেশি ভালোবাসতেন। চন্দ্রদেবের কাছে রোহিণী যেরকম প্রিয়তমা ছিল অন্যান্য দক্ষ কন্যারা সেইরকম হয়নি। চন্দ্রদেব সাতাশটি দক্ষ কন্যার মধ্যে থেকে রোহিণীকে সবথেকে বেশি ভালবাসলে অন্যান্য দক্ষ কন্যারা দুঃখিত হয়ে পিতার কাছে যান ও নিজেদের দুঃখের কথা পিতাকে জানান। মেয়েদের এই দুঃখ শুনে দক্ষরাজ অতিশয় দুঃখিত হলেন।
তিনি চন্দ্রদেবের কাছে গিয়ে বললেন,"হে কলানিধি চন্দ্র নির্মল কুলে তোমার জন্ম। আশ্রিত গণের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা তোমার উচিত নয় সকলকে সমান ভাবে দেখবে।" কিন্তু চন্দ্রদেব দক্ষ রাজার এই আজ্ঞা মেনে নিলেন না, তিনি পূর্বের ন্যায় একইরকমভাবে রোহিণীর প্রতি অত্যাধিক আসক্ত পরায়ন হয়ে অন্যান্য পত্নীদের অবজ্ঞা করতে লাগলেন। চন্দ্রের পত্নীরা দক্ষের কাছে নিজেদের এই অবহেলিত অবস্থার কথা জানালে দক্ষরাজ দুঃখিত হয়ে চন্দ্রকে ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হওয়ার অভিশাপ দিলেন। দক্ষরাজ চন্দ্রের কাছে গিয়ে বললেন, "তোমাকে অনেকবার অনুরোধ করেছি কিন্তু তুমি তা অবজ্ঞা করেছ এই জন্য তুমি ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হও।" এইশাপ বাক্য অনুযায়ী এইবার চন্দ্র ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্ষয় বিশিষ্ট হতে শুরু করলেন। চন্দ্র ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হলে সকলে হাহাকার করতে শুরু করল এবং দেবতা ও ঋষিগণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন তখন চন্দ্রের অনুরোধে সকল দেবতা ব্রহ্মার নিকট গিয়ে সকল বৃত্তান্ত খুলে বললেন।
ব্রহ্মা সমস্ত কথা শুনে বললে- "চন্দ্র এরকম মন্দ কার্য কেন করল? পূর্বেও এই চন্দ্র অনেক মন্দ কার্য করেছে। এই চন্দ্র দেবগুরু বৃহস্পতির গৃহে গিয়ে তাঁর পত্নী তারাকে হরণ করেছিলো পরে দৈত্যগণের সাহায্যে দেবগনের সাথে যুদ্ধ করেছিল। তখন আমি ও অত্রি চন্দ্রকে অনুরোধ করায় সে তারাকে ফিরিয়ে দেয়। অন্যদিকে তারা গর্ভবতী জেনে বৃহস্পতি তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন বৃহস্পতি বললেন, যদি তারা গর্ভ ত্যাগ করতে পারে তবে আমি তাকে গ্রহণ করবো। আমি তখন তারাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই গর্ভ কার দ্বারা উৎপাদিত? তারা বললেন, চন্দ্রের দ্বারা। তখন তারা গর্ভ ত্যাগ করলো, সেই গর্ভ থেকে একটি পুত্র উৎপন্ন হল, তার নাম বুধ। চন্দ্র নিজের পুত্র বুধকে গ্রহণ করলে পুনরায় আমাদের অনুরোধে বৃহস্পতি তারাকে গ্রহণ করলেন। এখন কী করা যায়? যা হওয়ার এখন তা হোক, এরপর চন্দ্র পবিত্র প্রভাস তীর্থ গিয়ে শিবের আরাধনা করুন, শিব প্রসন্ন হলে চন্দ্রের ক্ষয়রোগ শান্তি হবে।"
এরপর দেবগন চন্দ্রকে নিয়ে প্রভাস ক্ষেত্রে গমন করলেন চন্দ্র সেখানে সরস্বতী নদীর তীরে একটি গর্ত নির্মাণ করে দেবাদিদেব মহাদেবের পার্থিব মূর্তির পুজো করতে লাগলেন। দেবগন চন্দ্রকে প্রভাস তীর্থে রেখে নিজে নিজে স্থানে ফিরে গেলেন। চন্দ্র ছয় মাস মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র দ্বারা মহাদেবের পুজো করলেন এবং দশ কোটি মন্ত্র জপ করলেন।
তখন দেবাদিদেব মহাদেব প্রসন্ন হয়ে চন্দ্রকে বললেন- "হে চন্দ্র তুমি তোমার অভিলষিত বর প্রার্থনা করো।" তখন চন্দ্র বললেন, "হে দেবেশ আমার শরীরের ক্ষয় নিবারণ করুন। আমার অপরাধ ক্ষমা করে মঙ্গল বিধান করুন।" চন্দ্রের এই কথা শুনে শংকর বললেন, হে চন্দ্র কৃষ্ণপক্ষে তোমার কলার প্রতিদিন ক্ষয় হবে এবং শুক্লপক্ষে তোমার কলা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাবে এই সময় সেখানে দেবগন ও সকল ঋষিগণ উপস্থিত হয়ে দেবাদিদেব মহাদেব কে বললেন,"হে প্রভু আপনি দেবী উমার সঙ্গে এখানেই অবস্থান করুন।" চন্দ্র মন্ত্রের দ্বারা সেখানে শঙ্করের প্রতিষ্ঠা করলেন ভগবান শঙ্কর সেই স্থানকে উত্তম তীর্থে পরিণত করার জন্য এবং চন্দ্রের যশের জন্য সেখানে সোমেশ্বর নামে খ্যাত হলেন। এই পবিত্র প্রভাস ক্ষেত্রে যেখানে শিবের সোমেশ্বর লিঙ্গ দৃশ্যমান সেখানে চন্দ্র কুন্ডে ছয় মাস স্নান করলে যেকোনো দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মানুষ মুক্তি পায়। এইভাবে সোমেশ্বর লিঙ্গ উৎপন্ন হলো।
সোমেশ্বর লিঙ্গ উৎপন্ন হওয়ার কাহিনী শেষ হওয়ার পর মল্লিকার্জুন লিঙ্গের প্রসঙ্গ বা দেবাদিদেব মহাদেবের দ্বিতীয় জ্যোতির্লিঙ্গের প্রসঙ্গের উল্লেখ আছে। কুমার কার্তিক জন্মের পর থেকেই পার্বতীর কাছ ছাড়া ছিলেন, কখনও অস্ত্র শিক্ষার জন্য কখনও আবার অসুর নিধনের জন্য তাকে বেরিয়ে পড়তে হত কারণ তিনি ছিলেন দেব সেনাপতি। কিন্তু একবার গণেশ ও কার্তিকের বিবাহ প্রসঙ্গে কার্তিকের এমন রোষ সৃষ্টি হয় যে, তিনি পিতা মাতার উপর রাগ করে কৈলাস ত্যাগ করে চিরতরে চলে যান। কুমার কার্তিকের বিয়োগে যন্ত্রণায় দেবী পার্বতী তখন অতিশয় দুঃখিত হয়ে পড়লে দেবাদিদেব বললেন, "হে প্রিয়ে তুমি দুঃখ ত্যাগ করো তোমার পুত্র অবশ্যই ফিরে আসবে।" যখন এই কথায় দেবী পার্বতী শান্ত হলেন তখন দেবাদিদেব মহাদেব সকল দেবতা, গন্ধর্ব, অপ্সরাদের দিয়ে কুমারকে আনার চেষ্টা করলেন কিন্তু কুমার কার্তিক কিছুতেই ফিরে এলেন না। তখন দেবাদিদেব মহাদেব ও দেবী পার্বতী অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে কার্তিকের কাছে চলে গেলেন পিতা-মাতার আগমনের এই সংবাদ জানতে পেরে কার্তিক সেখানে থেকে তিন যোজন দূরে ক্রোঞ্চ পর্বতে চলে গেলেন। শিব ও পার্বতী তখন সেখানে গিয়ে জ্যোতিরূপ ধারণ করলেন। এইভাবে সেখানে 'মল্লিকার্জুন' নামের দ্বিতীয় জ্যোতির্লিঙ্গ প্রতিষ্ঠা হল। এই জ্যোতির্লিঙ্গ দর্শন করলে মানুষকে আর পুনর্জন্ম ভোগ করতে হয় না এবং সকল দুঃখ ও পাপের নাশ হয়।