একটি বেলপাতাতেই সন্তুষ্ট যিনি তিনি মহাদেব। তাকে খুব সামান্যতেই খুশি করা যায়। কিন্তু দেবাদিদেব মহাদেবের পুজোয় এমন একটি ফুল আছে যা নিবেদন করা যায় না, সেই নিষিদ্ধ ফুলটি যদি কেউ দেবাদিদেবের পুজোয় দেন, তাহলে না জেনেই তিনি মহাদেবের চরণে অপরাধ করে ফেলেন। এই ফুলটি হল কেতকী ফুল। এই কেতকী ফুল কেন শিব পুজোর অযোগ্য তা শিব পুরাণের জ্ঞান সংহিতার চতুর্দশ অধ্যায়ে রয়েছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই কাহিনী।
ঋষিগণ সুতকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কেন কেতকী ফুল শিব পুজোর অযোগ্য? এর উত্তরে সুত বললেন, একসময় রামচন্দ্র পিতৃ আদেশে তার স্ত্রী সীতা ও ভাই লক্ষণকে নিয়ে ১৪ বছরের জন্য বনগমন করেন। সেই সময় তিনি ফল্গু নদীর তীরে গিয়ে কিছুকাল অবস্থান করেছিলেন। সেই সময় তাদের পিতার শ্রাদ্ধের কাল উপস্থিত হয় এটি দেখে রামচন্দ্র কীভাবে শ্রাদ্ধ কার্য সম্পন্ন করবেন তা ভাবতে থাকেন এবং তিনি ভাই লক্ষণকে ডেকে শ্রাদ্ধের দ্রব্যাদি সংগ্রহের জন্য নিকটবর্তী একটি গ্রামে যেতে বললেন। রামচন্দ্রের কথা অনুযায়ী লক্ষণ তখন নিকটবর্তী একটি গ্রামে চলে গেলেন। এরপর অনেক সময় অতিবাহিত হওয়ার পরেও লক্ষণ আর ফিরে এলেন না, তখন সীতাকে একা রেখে রাম নিজেও চলে গেলেন।
অনেক সময় কেটে যাওয়ার পর দেবী সীতা ভাবতে লাগলেন যে মধ্যাহ্ন চলে গেছে। শ্রাদ্ধের কাজ নির্দিষ্ট সময়ে কীভাবে সম্পন্ন হবে আমার দেবর লক্ষণ ও এখনও ফিরে এলেন না। স্বামী ও ফিরে এলেন না। শ্রাদ্ধের সময় অতীত প্রায়। এরপর রাক্ষসী বেলা উপস্থিত হবে। এইসব ভেবে তিনি ফল্গুনদীতে স্নান শেষ করে ইঙ্গুদী তেলের প্রদীপ জ্বেলে রাম ও লক্ষণের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। রাম, লক্ষণ কেউ যখন ফিরে এলেন না তখন সীতা ভাবলেন আমি এখন নিজেই পিতৃগণকে পিন্ডদান করব। এই ভেবে সীতা পিন্ডদান সম্পন্ন করলেন। পিন্ডদান করবার সময় একটি দৈববাণী শোনা গেল, যেখানে দৈববাণী বলল, হে জনক নন্দিনী আমরা পরিতৃপ্ত হলাম। এতে তুমিও ধন্য হলে।
এই আকাশবাণী উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কতগুলি অলংকার ভূষিত হাত প্রসারিত হয়ে জানকী প্রদত্ত পিণ্ড গ্রহণ করল তা দেখে জানকী বললেন আপনারা কারা? আপনাদের কেবল হস্ত দেখা যাচ্ছে দেহের অন্য অংশগুলি দেখা যাচ্ছে না।
সীতার কথা শুনে তখন আকাশবাণী আবার বলে উঠলো, হে সীতা আমি তোমার শ্বশুর দশরথ। তোমার পিন্ডে আমি পরিতৃপ্তি পেলাম। তোমার দ্বারা কৃত শ্রাদ্ধকার্য সফল হয়েছে। এই কথা শুনে সীতা বললেন, হে পিতা আপনি হস্ত প্রসারিত করে পিণ্ড গ্রহণ করলেন এই কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। তখন আকাশবাণী বললেন তুমি এই বিষয়ে কতগুলি বস্তুকে সাক্ষী রাখো। এরপর সীতা ফল্গু নদী, ধেনুকা গরু, অগ্নি ও কেতকী পুষ্পকে বললেন, তোমরা এই বিষয়ে সকলে সাক্ষী রইলে। এরপর রাম ফিরে এসে জানকীকে বললেন, “হে সাধবী, তুমি এখন শুচি হয়ে প্রস্তুত হয়ে নাও। এখন শ্রাদ্ধ কাল গত প্রায়। তোমার শ্বশুরও এই সময় অন্তরালে উপস্থিত হয়েছেন। আর বিলম্ব করো না। সীতা এই কথায় বিমূঢ় হয়ে নীরবে বসে রইলেন, কোনও উত্তর দিলেন না।
সীতাকে দেখে রাম বললেন-হে বৈদেহী কেন তোমাকে এমন বিস্মিতার মত দেখছি? তখন দেবী সীতা রামচন্দ্রকে সমস্ত কথা খুলে বললেন। কিন্তু রামচন্দ্র এই কথায় বিশ্বাস করলেন না, তখন সীতা জানালেন যে এই কাজটি করার সময় তিনি কতগুলি বস্তুকে সাক্ষী রেখেছেন। তখন রামচন্দ্র বললেন যে, যাদেরকে তিনি সাক্ষী রেখেছেন তারা যদি সীতার কথাকে সত্য বলে স্বীকার করে তবেই তিনি সীতার কথায় বিশ্বাস করবেন।
এরপর সীতা ফল্গু নদী, ধেনুকা গরু, অগ্নি ও কেতকী পুষ্পকে ডেকে সাক্ষী দিতে বললে তারা মিথ্যা সাক্ষী দিল। তারা জানাল যে, তারা এই বিষয়ে কিছুই জানে না। সাক্ষীদের কথা শুনে রাম লক্ষণ দুই ভাই হেসে উঠলেন। এর পর নতুন করে শ্রাদ্ধকার্য শুরু হল এবং রামচন্দ্র শ্রাদ্ধ আরম্ভ করে পিতৃগণকে আবাহন করলে সূর্য মন্ডল থেকে আকাশবাণী হল, কেন পুনরায় আমাদের আবাহন করছ? জানকী আমাদের তৃপ্তি সাধন করেছে।
এই কথা শুনে রাম বললেন, আমি এই কথা মানলাম না। তখন পুনরায় আকাশবাণী থেকে একই কথা উচ্চারিত হল। রাম এবারও সেই আকাশবাণীর কথা না মানলে সূর্যদেব বললেন, তুমি কেন পুনরায় শ্রাদ্ধ করছ?
সূর্যদেবের কথা শুনে রাম লক্ষণ সীতার প্রতি প্রীত হয়ে বললেন, তাহলে আমাদের কুলে সীতার মত পবিত্রা বধূ আছে। রান্নার পর রাম ভোজন করে লক্ষণকে বললেন ভাই এই সকল সাক্ষীরা দুষ্টের মতো আচরণ করল। সীতা তখন ফল্গু নদীকে অভিশাপ দিলেন যে তিনি অন্তঃসলিলা হবেন। গরুকে অভিশাপ দিলেন যে, তোমার পুচ্ছদেশ পবিত্র ও মুখ অপবিত্র হোক। সীতা অগ্নিকে অভিশাপ দিলেন, তুমি সর্বভক্ষক হবে এবং কেতকী পুষ্পকে অভিশাপ দিলেন, তুমি আজ সত্যি কথা বললে না এর জন্য তোমাকে ফল ভোগ করতে হবে। তুমি শিবের প্রিয় হলেও তুমি শিব পুজোর অযোগ্য হবে। এরপর থেকেই দেবী সীতার শাপ অনুযায়ী কেতকী পু্ষ্প শিব পুজোর অযোগ্য হয়ে উঠল।