আমরা জানি যে, যিনিই রুদ্র, তিনিই শিব। আর শিবই হলেন 'দিগম্বর'। 'দিগম্বর' মানে, 'বস্ত্রহীন' বা 'উলঙ্গ'। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই যে শিবকে 'দিগম্বর' বলা হচ্ছে, কেন বলা হচ্ছে?
কেউ বলেন শিব আসলে সন্ন্যাসী। সন্ন্যাসীর কোন বাঁধন থাকে না, এমনকি বস্ত্রের বন্ধনও না। সন্ন্যাসীর কোন আড়াল বা আবরণ থাকে না, এমনকি বস্ত্রের আবরণও না। জাগতিক কোন বস্তুর প্রতি সন্ন্যাসীর কোন মোহ থাকে না, এমনকি বস্ত্রের প্রতিও না। শিব তাই উলঙ্গ। শিব তাই দিগম্বর।
অনেকেই আবার বলেন যে, শিবের এই 'দিগম্বর' রূপের কল্পনা নাকি অনেক পরবর্তীকালের। মূলত জৈন ধর্মের প্রত্যক্ষ ফল। তাঁদের দিগম্বর শাখার প্রভাবেই কালক্রমে শিব দিগম্বর-যোগী হয়ে উঠেছেন।
তবে, যে-যা-ই বলুন, আমরা বলব গল্প। 'বরাহ পুরাণ'-এর গল্প। সেখানে শিব হলেন রুদ্র। আর রুদ্র হলেন 'অনিত্য'। ব্রহ্মা তাঁর স্রষ্টা। বারে বারেই রুদ্র নিজেকে বিনষ্ট করেন, আর বারে বারেই ভিন্ন ভিন্ন রূপে ব্রহ্মা তাঁকে সৃষ্টি করেন। তৃতীয় বার ব্রহ্মা যখন তাঁকে সৃষ্টি করলেন, তখন রুদ্রের চোখ হল পিঙ্গল বর্ণের, গায়ের রঙ হল নীললোহিত।
অভূতপূর্ব রূপে রুদ্রকে সৃষ্টি করতে পেরে ব্রহ্মার দারুণ আনন্দ হল। সেই আনন্দে রুদ্রকে তিনি কাঁধে তুলে নিলেন। রুদ্রকে কাঁধে তুলতেই চতুরানন ব্রহ্মার আর-একটি মাথা উদ্গত হল। অমনি তাঁকে সকলে 'পঞ্চানন' নামে অভিহিত করলেন।
রুদ্রকে শুধু কাঁধে তুলেই ব্রহ্মার আনন্দের পরিসমাপ্তি হল না। তিনি রুদ্রের অনেকগুলি নাম দিতে গেলেন। আর সেটা করতে গিয়ে তিনি প্রথমেই রুদ্রকে 'কপালিন্' বলে সম্বোধন করে বসলেন। কিন্তু এই নাম শোনামাত্র রুদ্র ভয়ানক রেগে গেলেন। রাগে কাঁপতে কাঁপতে তিনি ব্রহ্মার সদ্য-উদ্গত পঞ্চম মস্তকটি কড়ে আঙুলের নখ দিয়ে উপড়ে ফেললেন।
মস্তক উৎপাটিত করে তাঁর রাগ মিটল ঠিকই, কিন্তু নখ থেকে মস্তক ঝেড়ে ফেলতে পারলেন না কিছুতেই। মস্তকটি যেন আঙুলের সঙ্গে না-ছোড় আঠার মতো লেগে রইল। তখন রুদ্র আপন কৃতকর্মের জন্য দারুণ অনুতপ্ত হলেন। ব্রহ্মার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে লগ্ন-মস্তকটি থেকে মুক্তির উপায় জানতে চাইলেন।
চতুরানন ব্রহ্মা অনুতপ্ত রুদ্রকে ক্ষমা করলেন। বললেন, মস্তক থেকে মুক্তির একটাই উপায়; আর তা হল, যথাবিহিত কাপালিক ব্রতের উদযাপন।
এই ভাবে ব্রহ্মার উপদেশ পেয়ে রুদ্র গেলেন পাপনাশক মহেন্দ্র পর্বতে কাপালিক ব্রত উদযাপন করতে।
সেখানে মস্তকটি থেকে কেশ সংগ্রহ করে তা দিয়ে উপবীত নির্মাণ করে আপন অঙ্গে ধারণ করলেন। তারপর মস্তকটি তিন খণ্ড করলেন। প্রথম খণ্ড দিয়ে অক্ষমণি নির্মাণ করলেন, দ্বিতীয় খণ্ড জটায় ধারণ করলেন। অবশিষ্ট খণ্ডটি হল, করোটি। সেটি হাতেই লেগে রইল। সেই করোটি তিনি কাপালিকের মতো রক্তে পূর্ণ করে ব্রতপালন করতে তীর্থ ভ্রমণ শুরু করলেন।
তীর্থ করতে বেরিয়ে প্রথমে সমুদ্রে, তারপর একে একে গঙ্গা, সরস্বতী, শতদ্রু, মহানদী, দেবিকা, বিতস্তা, চন্দ্রভাগা, গোমতী, সিন্ধু, তুঙ্গভদ্রা, গোদাবরী, গণ্ডকী প্রভৃতি পুণ্যসলিলায় অবগাহন করলেন। তারপর দারুবন, কেদার, ভদ্রেশ্বর ও গয়াতীর্থ ভ্রমণ করলেন। গয়ায় ফল্গুর জলে স্নান করে পিতৃগণের উদ্দেশ্যে তর্পণ করলেন।
এই ভাবে ব্রহ্মাণ্ড পরিভ্রমণ করতে করতে রুদ্রের ছয়-ছয়টা বছর কেটে গেল। ব্রতের কৃচ্ছ্রপালন করতে করতে এত দিনে তাঁর পরনের কাপড়ও জীর্ণ হয়ে গেল। শতছিন্ন হয়ে তা খুলেও পড়ে গেল। তিনি নগ্ন হয়ে গেলেন। তবুও তাঁর হাত থেকে সেই করোটি বা কপাল কিন্তু খুলে পড়ল না।
এই অবস্থাতেই তিনি হিমালয়ের তীর্থে তীর্থে ভ্রমণ করতে লাগলেন। এমনি করে বারোটা বছর কেটে গেল। তখন একদিন হরিহরক্ষেত্র ও দেবঙ্গদে স্নান করে সোমেশ্বরের চরণে পুজো দিয়ে রুদ্র ক্রমে অযোধ্যা ও বারাণসীধামে গমণ করলেন।
বারাণসীতে এসে পুণ্যসলিলা গঙ্গায় স্নান করলেন রুদ্র। স্নান করে তটে উঠতেই কী আশ্চর্য, রুদ্রের ব্রত সম্পূর্ণ হল, তাঁর হাতের করোটি বা কপাল হঠাৎ খসে পড়ল!
কপাল বিমোচিত হতেই স্বয়ং ব্রহ্মা অন্যান্য দেবতাদের সঙ্গে নিয়ে রুদ্রের সম্মুখে উপস্থিত হলেন। বললেন, ওহে রুদ্র, তুমি যে-ভাবে পরম নিষ্ঠার সঙ্গে 'কাপালিক ব্রত' উদযাপন করলে, তা জগতের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবে। এই ব্রত করলে লোকেরা সমস্ত রকম ঘোরতর পাপ থেকে বিমুক্ত হতে পারবে। তুমি শিব, তাই এই ব্রত ত্রিলোকে 'শুদ্ধ শৈবব্রত' নামেও প্রসিদ্ধ হবে। তোমার অক্ষি পিঙ্গল, তাই ব্রত 'পিঙ্গল ব্রত' নামেও খ্যাতি পাবে। তাছাড়া এই ব্রতকালে তুমি নগ্ন হয়ে পড়েছিলে, তাই এই ব্রত 'নগ্নকপাল ব্রত' নামেও প্রসিদ্ধ হবে। আর এই পুণ্যস্থান, যেখানে করোটি বিমোচিত হয়েছে, তা 'কপাল মোচন' নামে তীর্থ হয়ে উঠবে।
আসলে এই যে ব্রতকালে শিব সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে পড়েছিলেন, তবুও যোগীর নিরাসক্তি নিয়ে তিনি ব্রত সম্পূর্ণ করেছিলেন, আপন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন; তাতে শিব ও ব্রত দুয়ের মাহাত্ম্যই বিবর্ধিত হয়েছে। এতে লোকসমাজে শুধু ব্রতের নামই 'নগ্ন' বিশেষণ পায়নি, শিবও 'নগ্ন' বা 'দিগম্বর' বিশেষণে বিভূষিত হয়েছেন, পূজিত হয়েছেন, আজও হয়ে চলেছেন; হয়ে রয়েছেন নিরাসক্তি ও বিমুক্তির প্রথ প্রদর্শক...