এই শহরেই এসেছিল ভারত তথা এশিয়ার প্রথম বিজ্ঞান বিভাগের নোবেল, কীভাবে?

নোবেলের শহর কলকাতা। এ শহরেই এসেছিল ভারত তথা এশিয়ার প্রথম বিজ্ঞান বিভাগের নোবেল। সময়টা ১৯৩০ সাল, ‘রামন এফেক্ট’-এর জন্য বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেলেন সিভি রামন। প্রথমবারের জন্য একজন নোবেলজয়ী বৈজ্ঞানিককে পেল ভারতবর্ষ।সি ভি রমন, ভারতীয় পদার্থ বিজ্ঞানের অন্যতম পথিকৃৎ! আজ রমন এফেক্ট আমাদের সকলের জানা।

সেই রমন এফেক্টের নেপথ্য থাকা মানুষটির পুরো নাম চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রমন। আলো কোনও অণুর উপর ক্রিয়া করলে অণুটি স্পন্দিত হয়, শক্তির রূপান্তর ঘটে। অন্যদিকে আলোর রং বদলে যায়। আলোর এই ধর্মকেই বিশ্বের সামনে নিয়ে আসেন রমন। রমন এফেক্টের নীতিকে নির্ভর করেই আজ সারা বিশ্বে স্পেকট্রোস্কপির সাহায্যে মানবদেহের রোগাক্রান্ত কোশগুলোকে শনাক্ত করা যাচ্ছে, মৌলের শনাক্তকরণ করা সম্ভব হচ্ছে। এই সব কিছু্র নেপথ্যেই ভারতের বিজ্ঞান সাধক রমন।

১৮৮৮ সালের ৭শে নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত অধুনা তিরুচিরাপল্লীতে তাঁর জন্ম হয়। রমনের বাবা চন্দ্রশেকারাম রমানাথান আইয়ার নিজেও পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই রমন ছিলেন মেধাবী, পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ এতোটাই ছিল যে বাল্যকাল থেকে নিয়মিত লাইব্রেরী যেতেন।

১৯০৩ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে রমন তদানিন্তন মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। রমন পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক হন। কিন্তু ছাত্রাবাসে থাকাকালীন তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। শিক্ষকেরা বিলেতে গিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পরামর্শ দিলেও, তিনি যেতে পারেননি। তাঁর স্বাস্থ্য তাঁর আগামীর অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, ডাক্তারেরা পরীক্ষা করে বলেন, বিলেত যাওয়ার পক্ষে রমন স্বাস্থ্য উপযোগী নয়। অগত্যা দেশেই শুরু করেন স্নাতকোত্তরের পাঠ।প্রেসিডেন্সি থেকে স্নাতকোত্তরে প্রথম স্থান লাভ করেন।

IMG-20240228-WA0018


১৯০৭ সালে মাত্র আঠারো বছর বয়সেই রমন ফাইন্যান্সিয়াল সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ন হন।

কলকাতায় তিনি সহকারী অ্যাকাউন্ট্যান্টের পদে নিযুক্ত হন। চাকরির পরীক্ষাতেও প্রথম হয়েছিলেন তিনি। চাকরি পাওয়ার ঠিক আগের বছর, ১৯০৬ সালে রমনের প্রথম গবেষণা প্রকাশিত হয়। সেটিও আলোর প্রকৃতির উপরেই ছিল। তাঁর শিক্ষক এই গবেষণাকে খুব একটা গুরুত্ব দেননি। তাই রমন গবেষণা পত্রটি নিজেই ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিনে পাঠিয়ে দেন। গবেষণাটি প্রকাশিত হয় এবং বিজ্ঞানী মহলে বিপুল প্রশংসা আদায় করে নেয়। তাঁর দ্বিতীয় গবেষণার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে মজার একটি ঘটনা। রমন যে তখনও একজন ছাত্র মাত্র, তা নোবেলজয়ী ব্রিটিশ বিজ্ঞানী লর্ড র‍্যালে জানতেন না। র‍্যালে রমনের গবেষণায় অনুপ্রাণিত হয়ে রমনকে চিঠি লেখেন, সেখানে রমনকে তিনি প্রফেসর বলে সম্বোধন করেন। র‍্যালে ভেবেছিলেন, এই গবেষণা নিশ্চিতভাবে কোনও এক অধ্যাপকেরই করা। তাঁর দ্বিতীয় গবেষণাটিও সমাদৃত হয়েছিল। রমনের আগ্রহ ছিল গবেষণায়। কিন্তু সংসার চালানোর জন্য দরকার টাকার, তাই রমন দশ বছর অর্থ বিভাগে চাকরি করেন। এই এক দশক তিনি কিন্তু থেমে থাকেননি, তাঁর গবেষণার ইচ্ছাও দমে যায়নি।

এই সময়ে তিনি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অব সায়েন্সে নিজের অবসর সময়ে গবেষণা করতেন। গবেষণার পাশাপাশি নানান বিজ্ঞান বিষয়ক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতেন রমন। ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন রমন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের পদের জন্য, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে আমন্ত্রণ করে। ১৯১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করেন রমন। হয়ে ওঠেন পূর্ণ সময়ের গবেষক। তাঁর ইচ্ছে পূরণ হয়।

১৯২১ সাল, ইতিহাস তখন তৈরি হওয়ার পথে; সমুদ্রযাত্রা করে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার পথে সমুদ্রের নীল জল দেখে র‍্যালের তত্ত্ব নিয়ে তাঁর মনে সন্দেহের উদয় হয়। র‍্যালের বিক্ষেপণের কারণে আকাশের রং নীল হয় মানলেও, সমুদ্রের জলের রঙ নীল হওয়ার কারণ হিসেবে র‍্যালের ব্যাখ্যা মানতে পারেননি রমন।

র‍্যালে বিক্ষেপণ নমনীয়, আলোর কণা বায়ু মাধ্যমের মধ্য দিয়ে আমাদের চোখে আসে। তখন বিক্ষিপ্ত কণাগুলো গ্যাসের অণুর উপর ক্রিয়া করার সময় কোনরূপ শক্তি হারায় না। এজন্যে তাদের বর্ণের কোনরকম পরিবর্তন হয় না! এখানেই রমন খুঁজে পেয়ে গেলেন গবেষণার বিষয়।

৯২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতে ফিরে আসেন রমন। তিনি আকাশের রং, সমুদ্রের জলের রঙের কারণ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। আবিষ্কার করেন, আলোর বিক্ষেপণের কারণেই সমুদ্রের জলের রং নীল হয়। নেচার পত্রিকায় তা পাঠিয়ে দেন।

রমন এবং তার ছাত্ররা গ্যাস, তরল এবং কিছু কঠিনের মধ্য দিয়ে সাধারণ দৃশ্যমান আলোর বিক্ষেপণ নিয়ে গবেষণা করতে থাকেন। একবর্ণী আলোক রশ্মি ব্যবহার করে, বিভিন্ন তরলের মধ্যে এই আলোর বর্ণে পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। তবে আলোর পরিবর্তন খুব ক্ষীণ হওয়ায় তিনি আরও গবেষণা চালিয়ে যান।

অবশেষে ১৯২৭ সালে গ্লিসারলের মধ্যে আলোর স্পষ্ট বর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করেন রমন। তিনি কাঁচ ও ক্রিস্টালের মধ্যে আলোর বিক্ষেপণ পর্যবেক্ষণ করেন। তার গবেষণায় ব্যবহৃত আলো পোলারাইজড হওয়ায় বর্ণ পরিবর্তনের ঘটনাটিকে কোনভাবেই ফ্লোরোসেন্স বলা যায় না, অতএব তাঁর আবিষ্কার মৌলিক! আলোর পোলারাইজেশন ঘটার ফলে আলোর বর্ণ পরিবর্তন। যা রমন ইফেক্ট নামে পরিচিত। রমনের এই গবেষণায় অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করে তাঁর ছাত্র এবং গবেষণা সহযোগী কৃষ্ণান। ১৯৩০ সালে সি ভি রমন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পান। এরপরে আবিষ্কৃত হয় রমন স্পেক্ট্রোস্কপি যা আজ বিশ্বের উন্নত রসায়ন গবেষণাগারে বিভিন্ন পদার্থের শনাক্তকরণে ব্যবহৃত হচ্ছে। ব্যবহৃত হচ্ছে চিকিৎসাবিজ্ঞানে রোগ সনাক্ত করতে।

এই সবের আঁতুরঘর ছিল আমাদের কলকাতা। আইএসিএস-এ বসে শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও তিনি কাজ করে গিয়েছেন। সাধারণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি হওয়া যন্ত্রাংশের মধ্যে দিয়ে বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ঘটিয়েছেন। সাফল্য এসেছে। উজ্জ্বল হয়েছে দেশের নাম। সফল হয়েছে মহেন্দ্রলাল সরকারের স্বপ্ন। আশুতোষ দে অর্থাৎ আশু বাবু রমনের গবেষণায় অনেক সাহায্য করেছিলেন।

শুধু ভারতীয় মহাদেশ নয়, সমগ্র এশিয়ার মধ্যে তিনিই প্রথম বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯২৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সি ভি রমন ঘোষণা করেছিলেন ‘রমন এফেক্ট’র কথা। ১৯৮৬ সালে ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি কমিউনিকেশন ভারত সরকারকে সুপারিশ করেছিল ২৮ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় বিজ্ঞান দিবস হিসেবে ঘোষণা করার জন্য। ভারত সরকারের সম্মতিতে ১৯৮৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রথমবার পালিত হয় জাতীয় বিজ্ঞান দিবস। ২০২৪ সালের জাতীয় বিজ্ঞান দিবসের থিম Indigenous Technologies for Viksit Bharat'

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...