শিবের এক নাম, 'পশুপতি'-এ তো আমরা সবাই জানি। সেই কবেকার সুপ্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার উৎকীর্ণ সিলে পশুপতি শিবের মূর্তি আমরা দেখেছি, নেপাল বা মধ্যপ্রদেশের সুবিখ্যাত 'পশুপতিনাথ মন্দির'ও আমরা অনেকেই হয়তো দর্শন করেছি, সেখানে পুজো দিয়েছি; কিন্তু শিবের নাম 'পশুপতি' কেন হল তার পৌরাণিক কাহিনি হয়তো আমরা অনেকেই জানি না। তাই আসুন, আজ সেই কাহিনিরই অবতারণা করি:
কাহিনিটি পাওয়া যায় 'বরাহ পুরাণ'-এ। এই পুরাণ মতে, বিষ্ণু-ই হলেন আদিতম দেবতা। কারণ, সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ড যখন জলমগ্ন ছিল, সৃষ্টি বলতে তেমন কিছুই ছিল না; তখন সেই অপার জলে অনন্তশয্যায় শুয়ে একমাত্র বিষ্ণু বর্তমান ছিলেন। আর কেউ ছিল না, কিচ্ছু ছিল না।
যাই হোক, এভাবে একা থাকতে থাকতেই এক সময় অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন বিষ্ণু। ফলে, তাঁকে পরিকল্পনা করতে হল সৃষ্টির। কিন্তু, পরিকল্পনা করলেও স্বয়ং তিনি সৃষ্টির কাজে ব্রতী হলেন না। পরিবর্তে পরিকল্পিত সেই সৃষ্টিকর্মের ভার দিতে চাইলেন একজন সৃজনকর্মীর হাতে। সেই উদ্দেশ্যেই এই অবসরে তিনি আপন নাভিপদ্ম থেকে উদ্ভিদের মতো জন্ম দিলেন ব্রহ্মাকে।
উদ্ভূত হয়েই ব্রহ্মা সবিনয়ে বিষ্ণুর কাছে আপন উদ্ভবের কারণটি জানতে চাইলেন। তখন শুধুই স্মিত হেসে বিষ্ণু বললেন, সৃজন করো, ওহে বৎস সৃজন করো। ধ্যানস্থ হও!
তাই শুনে ব্রহ্মা ধ্যানস্থ হলেন। ধ্যানস্থ হতেই তিনি বিষ্ণুর সমগ্র সৃষ্টি-পরিকল্পনা আত্মস্থ করে ফেললেন। তখন শুরু করলেন সৃজন।
সৃজনকর্মে ব্রতী হয়ে ব্রহ্মা প্রথমেই অপরাপর দেবতাদের সৃষ্টি করলেন, স্বর্গ-মর্ত-পাতাল সৃষ্টি করলেন, চন্দ্র-সূর্য-নক্ষত্র সৃষ্টি করলেন। তারপর দেবতাদের জন্য স্বর্গ নির্দিষ্ট করে মর্ত ও পাতালের জন্য জীব সৃষ্টিতে নিরত হলেন। কিন্তু, মনের মতো জীব সৃষ্টি করতে না-পেরে নিরস্ত হলেন।
আর ঠিক তখনই তিনি প্রয়োজন অনুভব করলেন আর-একজন সৃজনশিল্পীর, যিনি সবকিছুই খুব সুন্দর করে ও আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে সৃষ্টি করবেন। ফলে, সেই সৃজনশিল্পীকে জন্ম দিতে তিনি আবার ধ্যানস্থ হলেন। আর ধ্যানস্থ হতেই অমনি তাঁর ললাট থেকে ঘোর লোহিতকৃষ্ণ এক পরমপুরুষের জন্ম হল।
জন্মেই পুরুষটি অসম্ভব তীব্র স্বরে রোদন করতে লাগলেন। তাই শুনে ব্রহ্মা তাঁর নাম দিলেন, 'রুদ্র'। তারপর সস্নেহে বললেন, ওহে রুদ্র, রোদন করো না! সুন্দর জীব-সৃষ্টির জন্যই তো তোমার আবির্ভাব, কান্না থামিয়ে তুমি বরং সত্বর সেই সৃষ্টিকর্মে প্রবৃত্ত হও!
ব্রহ্মার কথা শুনে রুদ্র প্রসন্ন হয়ে কান্না থামালেন। তারপর ঝটিতে সুন্দরী এক কন্যা সৃষ্টি করে অনন্ত সলিলে ডুব দিলেন। ডুব দিলেন তো দিলেন, আর উঠবার নামই করলেন না। তাঁর জন্য ব্রহ্মা কত কাল অপেক্ষা করলেন, দেবতারা কত কত কাল অপেক্ষা করলেন; কিন্তু রুদ্র তথাপি সলিল থেকে নির্গত হলেন না।
তারপর আরও বহুকাল গেল। তবুও রুদ্র সলিল থেকে বেরিয়ে এলেন না।
এদিকে সৃষ্টির অপেক্ষায় মর্ত-পাতাল তখনও খাঁ খাঁ করছে দেখে এবার ব্রহ্মার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল।
তিনি পুনরায় ধ্যানস্থ হয়ে প্রজাপতি প্রভৃতি অসংখ্য মানসপুত্রদের সৃষ্টি করতে শুরু করলেন। ক্রমশ সংখ্যায় তাঁরা এতই গরিষ্ঠ হয়ে উঠলেন যে, সৃষ্টি কাঁপিয়ে আরও সৃষ্টি-বৃদ্ধির জন্য তাঁরা একেবারে 'ব্রহ্মযজ্ঞ' আরম্ভ করে দিলেন। দেবতারা অবিলম্বে সেই যজ্ঞে যোগ দিলেন।
ঠিক এই মুহূর্তেই সলিল থেকে উঠে এলেন রুদ্র। এসে দেখলেন যে, তাঁকে বাদ দিয়েই দেবতারা অপরাপর ব্রহ্ম-পুত্রদের সঙ্গে সৃষ্টিকর্মে মগ্ন হতে যজ্ঞ শুরু করে দিয়েছেন! সৃষ্টির প্রয়োজনেই তাঁর উদ্ভব, অথচ সৃষ্টিকর্মে তাঁকেই ব্রাত্য রাখা হল! এর মানে তো একটাই, অপমান!--এ-কথা মনে হতেই রুদ্র ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। তাঁর সমস্ত ক্রোধ গিয়ে পড়ল সমগ্র দেবতাদের ওপর।
ক্রমান্বয়ে রাগে কাঁপতে কাঁপতে তাঁর শরীর থেকে অগ্নিশিখা নির্গত হতে লাগল, দেহ পিঙ্গলবর্ণ ধারণ করল। মুহুর্মুহু বজ্র-বিদ্যুতে চরাচরে জেগে উঠল বিনাশের শঙ্কা। সেই আবহে ক্ষিপ্র গতিতে ক্রোধ কম্পিত রুদ্র চব্বিশ হাত দীর্ঘ এক ধনু ধারণ করে অমনি তাতে তিনখানা গুণ যোজনা করে ফেললেন। তারপর তাতে একইসঙ্গে অসংখ্য শর স্থাপন করে যজ্ঞস্থলে উপস্থিত দেবতাদের দিকে ঝড়ের গতিতে নিক্ষেপ করতে শুরু করলেন।
আকস্মিক এই আক্রমণে সকলেই একেবারে বিহ্বল হয়ে গেলেন। এই বিহ্বলতার মুহূর্তেই শরসমূহের আঘাতে পূষার দাঁতের পাটি ঝুলে পড়ল, ভগের চোখ নষ্ট হয়ে গেল, ক্রতু বিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। আর এমনটা হতেই উপস্থিত সকলে সম্বিত ফিরে পেয়ে ভয়ে-ত্রাসে 'ত্রাহি ত্রাহি' বলে অসম্ভব চিৎকার করতে করতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যজ্ঞভূমি ছেড়ে চতুর্দিকে ছোটাছুটি শুরু করলেন। কিন্তু তাতেও তাঁরা পালাবার পথ খুঁজে পেলেন না। অরণ্যভূমে পশুরা যেমন চতুর্দিকের ঘেরা জালে অসহায়ভাবে আবদ্ধ হয়ে পড়ে, তেমনি ভাবেই রুদ্র সর্বব্যাপ্ত হয়ে পলায়ন তৎপর দেবতাদের পালানোর সমস্ত পথ আটকে দিলেন। তারপর তাঁদের সকলকে একইসঙ্গে হত্যা করতে উদ্যত হলেন।
দেবতারা ভয়ে 'ত্রাহি ত্রাহি' বলে পরমপিতা ব্রহ্মার শরণ নিয়েছিলেন। চরম-সংকট মুহূর্তটি কাছে আসতেই উদ্যতধনু রুদ্রের সম্মুখে তাই বরাভয় নিয়ে স্বয়ং ব্রহ্মা আবির্ভুত হলেন। ক্রুদ্ধ রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে খানিক শান্ত করলেন। তারপর বললেন, হে রুদ্র-মহাদেব, যজ্ঞ তো পণ্ড হয়েছে! ক্রোধে আর প্রয়োজন কী!
উত্তরে রুদ্র বললেন, হে ব্রহ্মা! তুমি আমাকে সৃষ্টির জন্যই সৃজন করেছ। এ-কথা দেবতারাও জানে। তবুও সৃষ্টিযজ্ঞে তারা আমাকে উপেক্ষা করে অপমান করল! তাই এই মূঢ়দের আমি শাস্তি দিয়েছি!
ব্রহ্মা বুঝলেন, রুদ্রের কথার ওপর আর কথা চলে না। দেবতাদের সত্যিই অন্যায় হয়েছে। তিনি রুদ্রের স্তুতি-বন্দনা করে দেবতাদের ক্ষমা চাইতে বললেন।
দেবতারাও নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। তাই পরমপিতার কথায় প্রথমে তাঁরা মাথা নীচু করে স্তবগানে রুদ্রের বন্দনা করলেন। তারপর বিনীতভাবে ক্ষমা চাইলেন।
তাঁদের বিনয়ে রুদ্র তুষ্ট হলেন বটে, তবে ক্ষমাদানের জন্য একটি শর্তও রাখলেন। বললেন যে, ক্রোধকালে দেবতাদের তিনি জালবদ্ধ পশুদের মতো দমন করেছেন। তাই দেবতাদের একবার পশুরূপ ধারণ করতেই হবে এবং তাঁকে নিজেদের অধীশ্বর 'পশুপতি' বলে স্বীকার করতে হবে, তবেই তিনি ক্ষমাদান করবেন।
রুদ্রের প্রস্তাবে দেবতারা অনায়াসেই সম্মত হলেন এবং 'স্বস্তি' উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তখনই পশুরূপ ধারণ করলেন। তারপর রুদ্রকে 'পশুপতি' বলে স্বীকার করে প্রণতি জানালেন।
দেবতাদের এই আত্মনিবেদনে তুষ্ট হয়ে রুদ্রশিব তাঁদের কৃপা করলেন, নষ্ট যজ্ঞের ফল দান করলেন। পূষা-ভগ-ক্রতুকে সুস্থ করে দিলেন। তারপর সকলকে ব্রহ্মজ্ঞান দান করে দিলেন নিষ্কাম মোক্ষের সন্ধান। আর সেই সঙ্গে তিনি নিজেও সর্বসিদ্ধিদাতা দেবতা হয়ে 'পশুপতি' শিবরূপে সর্বলোকে পূজিত হতে শুরু করলেন।