সতীর দেহখন্ড সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় পতিত হয়েছিল বাংলায়। পূব এবং পশ্চিম দুই বাংলাতেই। পূর্ব ভারতের এই প্রদেশটি বোধহয় যুগ যুগ ধরে তাই শক্তির সাধনা করে এসেছে। শিব দক্ষযজ্ঞ নাশ করে মৃত পার্বতীকে কাঁধে নিয়ে তান্ডব করেছিলেন। তাঁকে শান্ত করার জন্য বিষ্ণুর চক্র খন্ড খন্ড করে ফেলে পার্বতীর শরীর। সেই দেহাংশ ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা ভারত ভূখন্ডে। সেই সেই স্থানে গড়ে উঠেছিল শক্তিপীঠ। কিন্তু বাংলার শক্তিপীঠগুলোর মাহাত্ম্য আলাদা।
শক্তির দেবীর উগ্রতা যেন অনেকটাই এখানে শান্ত। বাংলার মাটির সহজ মায়ায় সেই দেবী তাঁর দেবীত্বটুকু পূর্ণভাবে বজায় রেখেও যেন মায়ের মতো স্নিগ্ধ। তাঁকে দূরের মনে হয় না। হিমালয় কন্যা, শিবজায়া অনায়াসে হয়ে ওঠেন বাঙালির ঘরের মেয়ে উমা। দীন দরিদ্র বাপ মায়ের সাদামাটা জীবনে সে অভ্যস্ত। সারা বছর দুঃখী জীবনের মাঝে চার দিনের জন্য সে আসে আনন্দময়ী হয়ে।
কন্যার জন্য কবি লেখেন আগমনীর গান। স্বামীগৃহে ফিরে গেলে লেখা হয় বিজয়াগীতি। ভোরবেলা মেটে উঠোনে একতারা বাজিয়ে গান গেয়ে যায় বাউল।
পূর্ব ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বদল ঘটেছে দেবীর রূপের। এক সময় শক্তির দেবী ছিলেন নগ্নিকা অপর্ণা। শ্মশানবাসী শিবের সঙ্গে শ্মশানে থাকেন দেবী। পরনে গাছের ছাল বাকল। সেখান থেকে লাল পেড়ে বাঙালি মেয়ের সাজে বদলে যান দেবী।
বাংলায় শক্তিপুজো কবে প্রথম শুরু হয়েছিল তার কোনও সঠিক সন তারিখ পাওয়া যায় না। তবে শক্তির দেবীর বিভিন্ন রূপের আরাধনা আর্য আগমনের আগে থেকেই পূর্ব ভারতে প্রচলিত ছিল বলে মনে করা হয়। সতীর দেহত্যাগ ও সতীপীঠের সৃষ্টি কাহিনিতে সাধারণের মধ্যে শক্তি আরাধনার প্রসার ঘটে।
বাংলার উত্তর থেকে দক্ষিণে ছড়িয়ে আছে অজস্র সতীপীঠ। দেবী পার্বতীর বাঁ হাত পড়েছিল হুগলী জেলার রাজবল হাটে। দেবীর নাম হয় বিশাললোচনী। এই জেলারি আর এক জনপদ ধনেখালির কাছে বালিদাঙ্গা গ্রামে পড়েছিল ডান পা। দেবীর নাম হয় রাজেশ্বরী।বর্ধমানের কাটোয়ার ক্ষীরগ্রামে পড়েছিল দেবীর পিঠের অংশ বিশেষ, অন্যমতে আঙ্গুল। এখানে দেবীর নাম যোগ্যদা বা ভূতধাত্রী। বীরভূমের নলহাটিতে দেবীর গলার নলি, বক্রেশরে মন, ফুল্লরায় ঠোঁট, নন্দিপুরে হার, কঙ্কালীতলায় কঙ্কাল। পীঠ ভেদে দেবীর নামও নানাবিধ। নলহাটিতে দেবীর নাম কালী, বক্রেশ্বরে মহিষমর্দিনী, বাংলাদেশের যশোরে পতিত হয়েছিল দেবীর হাত, দেবী সেখানে যশোশ্বরী। বাংলাদেশের বরিশাল জেলায় সন্ধ্যা নদীর ধারে শিকারপুর গ্রামের সুগন্ধতীর্থে দেবীর নাসিকা পড়েছিল।
বাংলার উত্তরে জলপাইগুড়ি জেলার বৈকুণ্ঠপুর জঙ্গলের মধ্যে তিস্তার ধারে পড়েছিল শালবারিতে পড়েছিল দেবীর বাম পদ। এখানে দেবীর নাম ভ্রামরী। মেদিনীপুরের তমলুক অঞ্চলে দেবীতীর্থ বিভাসতীর্থ। দেবীর নাম বর্গভীমা। মুর্শিদাবাদের কিরীটকোনা তীর্থে দেবী কিরীটেশ্বরী। আবার বিমলা নামেও তিনি পরিচিত।
দেবীপীঠ নিয়ে জন্ম নিয়েছে গড়ে উঠেছে একের পর এক কাহিনি। স্থান মাহাত্ম্যে মুখে মুখে ফিরেছে মানুষের। শক্তিপীঠ আর মাতৃপীঠ হয়ে গিয়েছে এক। কিন্তু দেবী মাহাত্ম্যের কথা স্মরনে রেখেও এই দেবীকে আদরিনী কন্যা রূপে গ্রহনে বাঙালি দ্বিধাহীন। এখানেই বাঙালির দুর্গাপুজোর অনন্যতা।