অযোধ্যায় রাজা নাভি আর রানি মরুদেবীর পুত্র ঋষভদেব। একদিন তিনিও রাজা হলেন। এবং, অল্পদিনেই প্রবল পরাক্রমে পৃথিবী জয় করলেন। স্বর্গের অধিপতি ইন্দ্র তাঁর পরম মিত্র। তাই এই অবসরে ইন্দ্র তাঁকে অভিনন্দন জানাতে স্বর্গে আমন্ত্রণ জানালেন। সেদিন ইন্দ্রের সভায় দারুণ সমারোহ। অতিথি-সখা ঋষভদেবের মনোরঞ্জনের জন্য ইন্দ্র নৃত্যগীতের আয়োজন করেছেন। গন্ধর্ব-কিন্নরদের সঙ্গীতের পর, সেখানে নৃত্য-পরিবেশন করতে এলেন স্বর্গের সুন্দরীতমা অপ্সরা নীলাঞ্জনা। তাঁর রূপে বিদ্যুতের ছটা, সেই ছটায় দশদিক যেন আলোকিত। সেই রূপের দিকে তাকালে আর চোখ ফেরানো যায় না। দেবতাদের প্রণাম জানিয়ে সেই অনিন্দ্যসুন্দরী নীলাঞ্জনা শুরু করলেন নাচ। কিন্তু, নৃত্যের উপস্থাপনাটুকু করেই হঠাৎ স্থির হয়ে গেলেন। স্পন্দনহীন। তাই দেখে সমস্ত তালবাদ্য থেমে গেল। সবার চোখের সামনে তিনি মিলিয়ে গেলেন পঞ্চভুতে। ঘটনাটা এমন আকস্মিকভাবে ঘটে গেল যে, সবাই হতভম্ব হয়ে গেলেন। ঋষভদেব শুধু ভাবতে লাগলেন, এই যে অপ্সরা নীলাঞ্জনা, তাঁর অপূর্ব দেহকান্তি, অসাধারণ সৌন্দর্য, স্বর্গের সুখ--সমস্তই তাহলে ক্ষণস্থায়ী! সমস্তই নশ্বর! তাহলে তাঁর যে বিপুল পরাক্রম, অতুল সম্পদ, পৃথিবী জোড়া রাজপাট এসবও তো নশ্বর। সেই নশ্বরের পিছনে তিনি তবে ছুটছেন কেন! মনে বৈরাগ্য এলো। অনিত্য পেরিয়ে অব্যয়কে পেতে তিনি পুত্রদের মধ্যে রাজ্যপাট বিলিয়ে সংসার ত্যাগ করলেন।
সন্ন্যাস নিয়ে তপস্যায় গিয়ে বসলেন এক নির্জন তপোবনে। অনাহারে চলতে লাগল কঠোর তপস্যা। দীর্ঘ এগারো মাস তের দিন পর তপস্যা ভঙ্গ হল। দিনটা ছিল, বৈশাখের শুক্লা তৃতীয়া। এদিনই তিনি খুঁজে পেলেন ধর্মের পথ। দীর্ঘ উপবাসভঙ্গের জন্য পা রাখলেন জনপদের পথে। তিনি দিগম্বর সন্ন্যাসী। দিগম্বর সন্ন্যাসীরা কারও কাছে চেয়ে খান না, প্রয়োজন ছাড়া জনপদে যান না। এ-কথা তখনও সাধারণ মানুষ জানতেন না। তাই কেউ অনাহারক্লিষ্ট ঋষভদেবের সেবা-সৎকার করতে এগিয়ে এলেন না। ফলে, সেই অভুক্ত শরীরেই ঋষভদেব অনেক জনপদ ঘুরে শেষে এসে পৌঁছলেন হস্তিনানগরে। এখানকার রাজা শ্রেয়স একমাত্র জানেন, দিগম্বর সন্ন্যাসীর সৎকারের উপায়। নগরে ঋষভদেবের আগমন সংবাদ পেতেই তিনি স্বয়ং তাঁকে বরণ করে নিয়ে গেলেন। পান করতে দিলেন, আখের রস। শ্রেয়সের দেওয়া এই পানীয় খেয়েই এদিন ভঙ্গ হল ঋষভদেবের দীর্ঘ উপবাস।
সেই থেকে 'অক্ষয় তৃতীয়া' জৈনধর্মের মানুষের কাছে ধর্মপথে পানীয় ও আহার দানে পুণ্য-অর্জনের দিন। জৈন-ধর্ম হল, এবার হিন্দু-পুরাণের 'অক্ষয় তৃতীয়া'-র গল্পটি শোনাই: কোন-এক গাঁয়ে এক কিপ্টে বামুন বাস করত। তার ধর্মজ্ঞান ছিল না, দয়ামায়াও ছিল না। তাই বৈশাখের এক দুপুরে এক পথিক যখন খিদেয়-তেষ্টায় খুব কাতর হয়ে তার বাড়িতে এসে জল ও খাবার চাইল; তখন সে 'দূর দূর' করে তাড়িয়ে দিতে চাইল। কিন্তু, বামুনের স্ত্রী সুশীলা ছিল দয়াবতী মহিলা। সে বামুনকে বেশ দু'কথা শুনিয়ে সেই অসহায় পথিককে পা ধোয়ার জল দিল, বসার আসন দিল, বাতাসা দিয়ে জল দিল, দুধ-খইয়ের ফলার খাওয়াল। খেয়ে-দেয়ে খানিক জিরিয়ে পথিক সুশীলাকে প্রাণভরে আশীর্বাদ দিয়ে বিদায় নিল।
ইতিমধ্যে হঠাৎ একদিন পাষণ্ড বামুনটা মরে গেল। তখন যমদূতেরা টেনে-হিঁচড়ে তাকে যমের বাড়ি নিয়ে চলল। পথে জলের তেষ্টায় সে ছটফট করতে লাগল, যমদূতদের পায়ে ধরে কত কাকুতিমিনতি করল; কিন্তু তারা জল তো দিলই না, উল্টে সারাটি পথ মুগুরের বাড়ি মারতে মারতে তাকে যমের কাছে নিয়ে গেল। কিন্তু, যম তাকে তেষ্টায় ছটফট করতে দেখে ছুটে গিয়ে নিজের হাতে জল খাওয়ালেন। তাই দেখে যমদূতেরা অবাক--ওকে নিজের হাতে জল দিলেন, প্রভু! ও যা পাষণ্ড, তাতে জল পাবার অধিকার তো ওর নেই!
যম বললেন, তোমরা ঠিকই বলেছ। বামুন অসহায় পথিককে তাড়িয়ে যে পাপ করেছে, তাতে ওর জল পাবার অধিকার নেই। কিন্তু, সেই দিনটা আর পাঁচটা দিনের মতো ছিল না। ছিল, বৈশাখের শুক্লা তৃতীয়া তিথি। এদিন বামুন অন্যায় করলেও বামুনের-স্ত্রী পথিকের সেবা-সৎকার করেছে। এদিন সতীর পুণ্যেই পতির পুণ্য হয়। তাই বামুন পাপ করলেও স্ত্রীর পুণ্যে তার পাপ নষ্ট হয়েছে। তাছাড়া, বৈশাখের শুক্লা তৃতীয়া এমন একটি তিথি, যেদিন একের পুণ্যের ভাগ পরিবারের সকলকে দিয়েও ক্ষয় হয় না। তাই এই তিথিকে বলা হয়, 'অক্ষয় তৃতীয়া'।
সুতরাং, হিন্দু এবং জৈন--এই দুই ধর্মের মোদ্দা কথা একটাই। 'অক্ষয় তৃতীয়া'- আসলে অসহায় ও অভুক্ত মানুষকে অন্নদানের দিন, তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর দিন। তাই এবার এই লকডাউনে 'অক্ষয় তৃতীয়া' যদি সার্থকভাবে উদযাপন করতে হয়; আসুন না, কিছু বিপন্ন-নিরন্ন মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিয়ে উদযাপন করি
গল্পের উৎস : দিগম্বর জৈন-সাধক জিনসেন সঙ্কলিত, ‘আদিপুরাণ’।
শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস রচিত, 'ভবিষ্য পুরাণ'।