মহাদেব কেন গায়ে ছাই ভস্ম মাখেন?

দেবাদিদেব মহাদেব হলেন শ্মশানবাসী, তিনি বাঘছাল পরে থাকেন আর ভূত-প্রেত নিয়েই তাঁর সংসার। তিনি ধ্যান মগ্ন হয়ে থাকেন, আবার প্রলয়ের সময় তিনি তান্ডব নৃত্য করেন। তাঁর সর্বাঙ্গে থাকে শ্মশানের ছাই, ষাঁড়ে চেপে তিনি সব জায়গায় ঘুরে বেড়ান এবং ডমরু বাজিয়ে মহানন্দে নৃত্য করেন। সর্বত্যাগী এই দেবতার গলায় থাকে সাপ। দেবাদিদেবের এই অদ্ভুত অঙ্গভূষণ, তাঁর পোশাক পরিধানের জন্য তিনি মানুষের কাছে বড্ড বেশি আপনার হয়ে ওঠেন। সামান্য বেল পাতা আর গঙ্গা জলে তুষ্ট হওয়ার কারণে তাঁর পুজোই হয় সব থেকে সহজতর।

সকল দেবতাদের দেবতা হ‌ওয়া সত্ত্বেও মহাদেব গায়ে ভস্ম কেন মেখে থাকেন তা আমি আজকে বলব। শিব পুরাণের সনৎ কুমার সংহিতার তৃতীয় অধ্যায়ে দেবাদিদেবের ভস্ম মাখার কারণ বিশদে বর্ণনা করা আছে।

দেবী পার্বতীর কৌতুহল নিরসনের জন্য দেবাদিদেব মহাদেব স্বয়ং পার্বতীকে  বলেছিলেন কেন তিনি গায়ে সবসময় ছাই ভস্ম মেখে থাকেন। দেবাদিদেব মহাদেব বলেছিলেন, বহুকাল পূর্বে ব্রহ্মা কর্তৃক সৃষ্ট উৎকৃষ্ট একজন তেজস্বী ব্রাহ্মণ ছিলেন, তিনি কঠোর নিয়ম অবলম্বন করে তীব্র তপস্যা করতেন তার‌ তপস্যা এমনই কঠোর ছিল যে, তিনি গ্রীষ্মকালে চারিদিকে অগ্নি প্রজ্বলিত করতেন আর মাথার ওপরে সূর্যের উত্তাপ সহ্য করতেন, শীতকালে জলের মধ্যে শয়ন করতেন এবং বর্ষাকালে প্রবল বারিধারায় সিক্ত হয়ে আকাশে অবস্থান করতেন।

এইভাবে কঠোর তপস্যা করতে করতে ক্ষুধাবোধ হলে তিনি কিঞ্চিৎ পরিমাণ আহার করতেন।  তার কঠোর তপস্যার প্রভাবে ভল্লুক, শরভ, সিংহ, শৃগাল সকল জন্তুরাই নির্ভয়ে তার কাছে আসতে শুরু করলো আর যারা মৃগ ও মাংস ভজন করত তারা প্রাণী হিংসা ভুলে শাকান্ন ভোজন করে তৃপ্ত হতে লাগল। সেই তেজস্বী ব্রাহ্মণ লবণহীন শাক আহার করে ত্রিলোকপর্ণাদ নামে বিখ্যাত হয়ে উঠলেন।

এইভাবে বহুবছর নিষ্ঠার সঙ্গে তপস্যা করে তিনি মনে মনে চিন্তা করলেন যে, আমি সত্য ধর্ম অবলম্বন করে তপস্যা করে আসছি কিন্তু যেদিন আমার দেহের রক্ত শ্বাপদের মত বিবর্ণ হবে সেদিন আমার তপস্যা সার্থক হবে। এরপর একদিন তপস্যাজনিত কাজের জন্য কুশ চয়ন করতে করতে তার হাতের মধ্যমা কেটে রক্ত বেরুতে থাকল, তখন তিনি দেখলেন যে তার শরীরের সমস্ত রক্ত শ্বাপদের মত বিবর্ণ হয়েছে।

এই দেখে তিনি আনন্দে হাসতে হাসতে নৃত্য করতে শুরু করলেন। তার নৃত্য দেখে বনের সমস্ত মৃগরা ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। তপস্বীর দীর্ঘদিনের তপস্যা অহংকারের প্রভাবে যাতে নষ্ট না হয় তাই স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব তখন ছদ্মবেশ ধারণ করে সেই তপস্বীর সামনে উপস্থিত হয়ে বললেন," হে বিপ্র কী জন্য আজ তোমার এমন ভাব উপস্থিত হল? তোমার এইরূপ আত্মঅহংকার করা অনুচিত! এই আত্ম অহংকার পরিত্যাগ না করলে তুমি তপস্যার ফল লাভ করতে পারবে না! এইভাবে আত্মপ্রসাদে বিভোর হয়ে বহু জন্মের অর্জিত তপস্যার ফলকে তুমি বিনষ্ট করো না।

মনে রেখো এই পৃথিবীতে তোমার মতো কঠোর তপস্বী আরও অনেকেই রয়েছেন কিন্তু তারা প্রত্যেকে আত্মাভিমান ত্যাগ করতে সক্ষম হয়েছেন।" এই বলে মহাদেব তার হাতের মধ্যমা অঙ্গুলি ছেদন করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই ক্ষতস্থান থেকে ক্ষীর ধারার মতো শুভ্র ভস্ম নির্গত হতে থাকল! তা দেখে ঐ তপস্বী অতিশয় বিস্মিত হলেন এবং তিনি নিজের ভুল বুঝতে পারলেন।

এরপর ওই তপস্বী মহাদেবকে জিজ্ঞেস করলেন," আপনি কি স্বয়ং ভগবান মহাদেব ছদ্মবেশ ধারণ করে আমাকে দর্শন দান করতে এসেছেন না চন্দ্র অথবা অন্য কোন দেবতা? কারণ আপনার আঙ্গুল ছেদন করে যে রস নির্গত হচ্ছে তা দেখে আমি অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছি!" তখন মহাদেব তপস্বীকে তাঁর নিজের রূপে দর্শন দিলেন, সারা অঙ্গে ভস্ম লেপন করা মহাদেবকে দর্শন করে তপস্বী পর্ণাদ বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে মহাদেবের চরণে লুটিয়ে পড়ে স্তব করতে লাগলেন।

ভস্মের এই উৎপত্তি কথা বর্ণনা করার পরে দেবাদিদেব দেবী পার্বতীকে বললেন,"এই ভস্ম দ্বারা আমি ওই তপস্বীর তপস্যা ভঙ্গ করে তার চেতনা জাগ্রত করি। এই নিমিত্ত আমি অঙ্গে ভস্ম বা ভূমি বিলেপন করি এবং এই ভস্ম‌ই আমার সর্বোৎকৃষ্ট ভূষণ। ভূমি স্নান‌ই মানবের সর্বোৎকৃষ্ট স্নান। কনখল, প্রয়াগ প্রভৃতিতে গঙ্গা স্নান করলে যে ফল লাভ হয় ভূমি স্নানেও সেই ফল লাভ হয়। ভূমিকে সকল কিছুই ভয় করে। তাই ভূমি স্নান করলে কোন ভয় থাকে না।"

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...