দেবাদিদেব মহাদেব কেন শ্মশানে বাস করেন?

সনাতন হিন্দু ধর্মে ত্রিদেব বলতে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরকে বোঝায়। এই তিন জনের মধ্যে মহেশ্বরকে দেবাদিদেব বলা হয়। কারণ তিনি দেবতাদের‌ও দেবতা। দেবাদিদেব মহাদেব গৃহী আবার সংসার সম্পর্কে উদাসীন। দেবাদিদেবের পত্নী দেবী পার্বতী তাই অন্নপূর্ণার রূপ ধারণ করে সংসার সামলে রাখেন আবার ভোলেবাবা যখন অল্পেতে তুষ্ট হয়ে কোন দৈত্য দানবকে বর দিয়ে বসেন তখন দেবী পার্বতী অসুর দলনী রূপ ধারণ করে সবদিক সামাল দেন। ভোলেবাবা মহেশ্বর দেবাদিদেব হলেও তিনি অন্যান্য দেবতাদের থেকে আলাদা। তিনি ছাই ভস্ম গায়ে মাখে থাকেন, পরণে তাঁর বাঘছাল। তাঁর সঙ্গী হলো নন্দী-ভৃঙ্গী আবার তার গৃহ কৈলাসে হলেও তিনি শ্মশানে শয়ন করেন এবং অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য তিনি প্রলয় সৃষ্টিকারী নৃত্য করেন, তাই তার অপর নাম রুদ্র।

দেবাদিদেব মহাদেব শ্মশানে বাস করেন- এই কথা সকলেই কম বেশি জানেন। কিন্তু তার শ্মশানবাসের প্রকৃত কারণ অনেকেরই অজানা। এই বিষয়টি 'শিব পুরাণে'র 'সনৎ কুমার সংহিতার' চতুর্থ অধ্যায়ে বিশদে বর্ণিত আছে। 'শিব পুরাণ' অনুযায়ী একবার দেবী পার্বতী নিজের কৌতুহল নিরসনের জন্য তার স্বামী দেবাদিদেব মহেশ্বরকে শ্মশানবাসের কারণ জিজ্ঞাসা করেন। দেবী পার্বতীর প্রশ্নের উত্তরে দেবাদিদেব মহাদেব যা বলেছিলেন তাই আজকে আপনাদের বলবো।

দেবী পার্বতী একবার তার স্বামী মহেশ্বরকে বলেন, আপনি সকল দেবতাদের প্রভু হওয়া সত্ত্বেও শ্মশানে শয়ন করেন। আপনার এই কর্মের পেছনে নিশ্চয়ই কোন গূঢ় কারণ আছে। আমি সেই গূঢ় বা গোপন কারণের কথা শুনতে চাই। কৃপা করে আপনি আমার সংশয় দূর করুন।

দেবাদিদেব মহাদেব তখন পার্বতীকে বললেন, বিধাতা আমার ওপর যে কর্মভার আরোপ করেছেন সেই সংহার কার্যের জন্য‌ই আমাকে শ্মশানে বাস করতে হয়। এই শ্মশান পুণ্যময় এক সিদ্ধ ক্ষেত্রস্বরূপ। তাই শ্মশান আমার প্রিয়। এখানে আমার অনুচর প্রমথগণ বাস করে এবং তাদের অনুরোধে আমিও বাস করি।

এই সমগ্র জগৎ সৃষ্টির পর সৃষ্টি , পালন ও সংহারের তিনটি কার্য ভাগ হয়ে যায় তিন আদি দেবতার মধ্যে। সৃষ্টির কাজ করেন সৃষ্টি কর্তা  ব্রহ্মা, সমগ্র জগৎ এর পালনকর্তা যেমন ভগবান নারায়ন তেমনি এই সমগ্র জগতের সংহারকর্তা হলেন মহাদেব। তাই মহাদেব হলেন সংহারক। সৃষ্টি ও পালনের সাথে সাথে অশুভ শক্তির ধ্বংস না হলে জগতের ভারসাম্য বজায় থাকবে না, তাই সংহারের‌ও গুরুত্ব আছে। কারণ পুরাতন জীর্ণ অশুভ যা কিছু তা সংহারের পরই আবার নতুন রূপে নতুন কিছু সৃষ্টি হয়। তাই এই মায়ার জগতের সবকিছুই অনিত্য।

অন্যদিকে বলা যায় আজ যে জন্মাচ্ছে কাল তার মৃত্যু অবধারিত, মৃত্যুর ক্ষেত্রে ধনী-গরীব, রাজা- প্রজা সকলেই সমান। এ এক অমোঘ সত্য, নিষ্ঠুর নিয়তি আর বিশাল জগতের এই সংহারের দায়িত্বভার রয়েছে মহাদেবের হাতে। সেই সংহারের  কাজ হয় শ্মশানের মধ্যে। দেহের অন্তে শ্মশানেই দাহ কার্য হয়। তাই শ্মশানবাসের মধ্য দিয়ে দেবাদিদেব মহাদেব নিজের কার্যের বিষয়টি তুলে ধরেন জগৎ এর সামনে আর একই সাথে ধ্বংস ও সংহারের কথাও জগতকে স্মরণ করিয়ে দেন, জগতকে মনে করিয়ে দেন তিনি যেমন অল্পে তুষ্ট হওয়া ভোলেবাবা ঠিক তেমনি ভাবে তিনিই অশুভ শক্তি ধ্বংসকারী সংহারক দেবতা রুদ্র।

এক‌ই সাথে যখন কোন ব্যক্তি অত্যন্ত অহংকারী  হয়ে ওঠে বা যখন কোন ব্যক্তি পাপের সাগরে ডুবতে থাকে, তখন শ্মশান তাকে তার পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে সংযত হওয়ার শিক্ষা দেয়।

সপ্তাহের অন্যান্য বারের মধ্যে সোমবার দেবাদিদেব মহাদেবের বার রূপে পরিচিত। এই দিন যদি কেউ ঘি, দুধ বা জল দিয়ে দেবাদিদেব কে স্নান করায় তাহলে সে খুব সহজেই মহাদেবের কৃপা লাভ করে থাকে। ভোলেবাবা খুব অল্পেই সন্তুষ্ট হন। সামান্য বেলপাতা ও গঙ্গাজল দিয়েই তাঁর অর্চনা করা সম্ভব। তিনি আবার মৃত্যুঞ্জয়ও।

তাই যে কোনো সংকটে অথবা বিপদে তার ভক্তরা তাকে স্মরণ করে থাকে আবার মহাদেবের মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করলে অকাল মৃত্যুযোগ ও কেটে যায়। শিব পুরাণে বলা আছে, যে ব্যক্তি মহাদেবের লিঙ্গ পুজো করে থাকে সে দেহের অন্তে পরম গতি  লাভ করে কারণ দেবাদিদেবের মূর্তি পূজা অপেক্ষা লিঙ্গ পূজায় উত্তম। শিব পুরাণে‌ মহাদেব স্বয়ং পার্বতীকে বলেছেন, "আমার মূর্তিপূজা অপেক্ষা লিঙ্গ পূজাই শ্রেয় জানবে। এই  পূজা দ্বারা মানুষ মৃত্যুর পর উৎকৃষ্ট লোকে গমন করে।"

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...