বাঙালি বিয়েতে কীভাবে শুরু হল টোপ পরার চল

বাংলা ক্যালেন্ডারে অঘ্রান মাস পড়তে না পড়তেই বেজে ওঠে বিসমিল্লার সানাই। হুড়োহুড়ি বিয়ের তোড়জোড়। নিমন্ত্রণপত্র, ছাদনাতলা, সাতপাক, কন্যাদান, বধূবরণ নানা রকম আচার। সময়ের সঙ্গে বদল এসেছে বিয়ের রীতি-রেওয়াজে। যোগ হয়েছে নানা রকম অনুসঙ্গ। কিন্তু বদলায়নি শুধু একটা জিনিস-টোপর। শোলার টোপর আর শোলার মুকুট বাঙালি বিয়ের সিগনেচার। বাঙালি হিন্দু বিয়ের প্রধান চিহ্ন এবং অন্যতম ঐতিহ্য।

ছাদনাতলায় মজা করে বলা হয়, টোপর শোলার হলেও ভারি কিন্তু লোহার মতো। বোঝাতে চাওয়া এ হল নতুন জীবনের দায়-দায়িত্বের ভার। টোপর শোলা দিয়ে তৈরী। বর্ণ সাদা। টোপরের রং সাদা। বিশ্বাস করা হয়, সাদা শুভ্রতা ও সাহসের প্রতীক।এই মস্তক আবরণী অলংকরণে বাংলার নিজস্ব আলপনার ডিজাইনে। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, টোপর সৌভাগ্য এনে দেয়। সাধারণত কনের বাড়ি থেকে টোপর পাঠানো হয় বরের বাড়িতে।  তবে টোপর শুধু বিয়ে নয়, অন্নপ্রাশন এবং উপনয়নেও ব্যবহার করা হয়।

টোপর নানা সাইজের হয়ে থাকে। টোপরের সঙ্গেই থাকে শোলার মুকুট। যা বিয়েতে নববধূর লাগে। অন্নপ্রাশনে লাগে ছোট টোপর। অন্নপ্রাশন এবং উপনয়ন দুই অনুষ্ঠানেই বরবেশে সাজানো হয়, তাই টোপর লাগে।   

টোপরের উৎপত্তি নিয়ে একটি কাহিনি প্রচলিত আছে। সেই কাহিনি অনুযায়ী, নিজের বিবাহ অনুষ্ঠানে ভোলা মহেশ্বরের একটি বিশেষ মস্তকাবরণী পরার ইচ্ছে হয়। দেবশিল্পী বিশ্বকর্মাকে তা প্রস্তুত করার দায়িত্ব দেন। সেই মস্তক আবরণী হতে হবে নরম কাঠের, যাতে মাথায় ভার না লাগে। কিন্তু বিশ্বকর্মা ছিলেন ধাতুশিল্পী তাই তিনি শিবের চাহিদামতো মস্তকাবরণী তৈরীতে ব্যর্থ হন।

 শেষ পর্যন্ত এক মালাকার নামের কারিগর জলা থেকে শোলা সংগ্রহ করে শিবের জন্য এক বিশেষ মস্তকাবরণী প্রস্তুত করে দেন। পরবর্তীতে এই মস্তকাবরণীই "টোপর" নামে পরিচিতি লাভ করেছে।

কথিত আছে, মালাকারের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে শিব পরবর্তীতে তাকে নিজের ব্যক্তিগত হস্তশিল্পী নিয়োগ করেছিলেন। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের শোলা শিল্পী মালাকার সম্প্রদায়ের মানুষেরা নিজেদের এই মালাকারের বংশধর মনে করেন। সেই কিংবদন্তির কারণেই এই সম্প্রদায়ের শিবপত্নী মহেশ্বরীর পুজো করে।

বিয়ের টোপর খুব সাবধানে ব্যবহার করা হয়। বিয়ের একবছর পর্যন্ত তা বিশেষ যত্নে সংরক্ষিত হয়। টোপর ভেঙে যাওয়া বা পুড়ে যাওয়া দুর্ভাগ্যের লক্ষণ বলে ধরা হয়। টোপর বা শোলা নির্মিত যে কোনো সামগ্রী নষ্ট হয়ে গেলে তাকে জলাশয়ের গর্ভে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। 

বাঙালি হিন্দু বিয়ের রীতিতে নানা রকম পরীক্ষা নিরিক্ষা-বাহুল্যের যোগ বা বিয়োগ ঘটলেও টোপরের রেওয়াজে কোনও বদল আসেনি সেভাবে। টোপরে ধনী-গরিব সব সমান। এ এক আশ্চর্য ‘সমান’ কাহিনি। 

 

       

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...