বিষ্ণুর মৎস অবতারের একমাত্র মন্দিরটি দেশে কোথায় আছে জানেন?

মৎস অবতার বিষ্ণুর দশাবতারের প্রথমরূপ। সত্যযুগে এই অবতাররূপে অবতীর্ণ হন তিনি। তিনি মৎসরূপ ধারণ করেছিলেন বেদ এবং মানবকে রক্ষার জন্য।

তখন অতীত কল্পের অবসান প্রায় আসন্ন। পদ্মযোনি তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ব্রহ্মা। তিনি ঘুমে আচ্ছন্ন হলেন। নিদ্রাকালে তার মুখ দিয়ে নির্গত হল নানা উপদেশাবলী। সেই উপদেশ বেদ নামে খ্যাত। সেই সময় হয়গ্রীব নামে এক অসুর সেই সব বেদরাজি শ্রবণ করল সেই বেদ চুরি করে পাতাল প্রবেশ করল। এই ঘটনা অজ্ঞাত থাকল না ভগবান শ্রীহরির। দানবের কাছ থেকে ওইসব বেদরাজি উদ্ধারের ভাবনায় তিনি একটি ক্ষুদ্র মৎস্যের রূপ ধারণ করলেন।

matso-1

এদিকে প্রাগৈতিহাসিক দ্রাবিড় রাজ্যের বিষ্ণুভক্ত রাজা ছিলেন সত্যব্রত। পরে তিনি মনু নামে পরিচিত হন। মনু এই পৃথিবীর প্রথম মানব। রাজর্ষি সত্যব্রত বৃতমালা নামে এক নদীতে স্নানে গেলেন। স্নান সেরে তর্পণ করার সময় অঞ্জলি পেতে করপুটে নদীর পবিত্র জল ভরলেন তিনি। ঠিক এই সময় শফরী নামধারী মৎস্যরূপী ভগবান তাঁর অঞ্জলিপুটে উঠে এলেন। হাতের জলে ক্ষুদ্র মৎস দেখে রাজর্ষি সেই জল ফেলে দিতে উদ্যত হলেন। তখন সেই মৎস কাতর স্বরে বলে উঠল, “হে কৃপাবৎসল রাজা, দোহাই এই নদীর জলে আমাকে ত্যাগ করবেন না। এখানে কেউ আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে না। বৃহৎ মৎস আমাকে খেয়ে ফেলবে। আমায় দয়া করুন”

ছোট্ট একটি মাছকে কথা বলতে দেখে রাজর্ষি সত্যব্রত অত্যন্ত বিস্মিত হলেন। তিনি শফরীকে তার কমণ্ডলুর জলে স্থান দিলেন। আশ্চর্যের বিষয় সেই দিনের মধ্যেই মাছের আয়তন বেড়ে গেল। কমণ্ডলুতে তার স্থান অকুলান। মাছ বলল, “হে রাজা, দয়া করে অন্য কোনও বৃহৎ স্থানে আমাকে রাখুন যাতে আমি সুখে থাকতে পারি।”রাজা তখন তাকে একটি বড় কলসিতে জায়গা দিলেন। এক রাতে মাছের চেহারা এত বেড়ে গেল যে, কলসিতে সামান্য নাড়া চাড়া করাও তার পক্ষে অসম্ভব হল।

মাছ এবার রাজাকে অনুরোধ করল এবার তাকে একটি সরোবরে ছেড়ে দিতে। রাজা তাই করলেন। এক রাতের মধ্যে দেখা গেল মাছটি এমন আকার ধারণ করেছে যে, সরোবরে বাস করাও তার পক্ষে কষ্টকর হচ্ছে। আরও বড় জায়গা চাই তার। রাজা এবার তাকে নিয়ে এলেন একটা হ্রদে। সেখানেও একই অবস্থা, এক রাতের মধ্যে ওই মাছ মহামৎস্যে পরিণত হল।

মাছ বলল–আমাকে আরও বড় এক পরিসরে রাখার ব্যবস্থা করুন। রাজর্ষি ঠিক করলেন, এই মাছের পক্ষে সমুদ্রই শ্রেয়। এই মনে করে সাগরের দিকে হাঁটলেন। মাছটি ভয় পেয়ে বলল, “রাজা আমাকে সাগরে দেবেন না। ওখানে বড় বড় জলজ জন্তু আমায় খেয়ে ফেলবে। আমার প্রাণ যাবে। রাজা সত্যব্রত বিনীত কণ্ঠে জানতে চাইলেন–হে রূপধারী মৎস্য, আপনি কে? কৃপা করে আপনি আমাকে আপনার পরিচয় জ্ঞাপন করে আমাকে উৎকণ্ঠা মুক্ত করুন।

matso-2

মৎস্যরূপী শ্রীভগবান বললেন–হে রাজর্ষি, আজ থেকে ছদিন পরে অর্থাৎ সাতদিনের মাথায় সমুদ্রে প্রলয় শুরু হবে। জলে ভেসে যাবে চারদিক। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল সব জলের তলায় চলে যাবে। সে সময় মস্ত বড় একটা নৌকা তোমার কাছে আসবে, আমিই তা পাঠাবো। তুমি ওই নৌকায় সব ধরনের বীজ, ওষধি এবং সাত ঋষিকে নিয়ে উঠে বসবে। বায়ুর প্রবল বেগে নৌকা টাল সামলাতে না পেরে টলমল করবে। ঠিক এ সময়ে একটা মোটা কাছি হাতের পাশে পাবে। আসলে এটা বহুরূপী এক সর্প, আর আমি এ সময়ে এক শৃঙ্গধারী মৎস্যরূপে জলে ভাসব। তুমি সেই কাছির এক প্রান্তে আমার মৎস্য শৃঙ্গের সাথে বাঁধবে। অন্যপ্রান্ত নৌকার সঙ্গে। দেখবে নৌকা স্থির হয়েছে।

শ্রীবিষ্ণু এই উপদেশ দান করে সেই স্থান থেকে সমুদ্রের অতুল নীল জলরাশিতে অদৃশ্য হলেন। রাজর্ষি সত্যব্রত শ্রীহরির আদেশ অনুসারে, বীজ, ওষধি এবং সাত ঋষিকে একত্রিত করে সেই নির্দিষ্ট দিনটির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

সপ্তম দিনে দেখা দিল সেই প্রলয় দুর্যোগ। সমুদ্রের জল ফুলে ফেঁপে উঠল। জলে প্রবল আলোড়ন দেখা দিল। প্লাবিত হল সম্পূর্ণ পৃথিবী। রাজা সত্যব্রত দেখলেন একটা নৌকা আসছে। তিনি সেই নৌকায় বীজ, ওষধি এবং ঋষিদের সঙ্গে নৌকোয় উঠে পড়লেন। সমুদ্রের বিশাল বিশাল তরঙ্গের আঘাতে নৌকা ডুবে যাওয়ার উপক্রম। বিপদের সম্ভাবনা দেখে রাজা সত্যব্রত আকুল হয়ে শ্রী ভগবানের স্মরণ নিলেন। সেই প্রলয় সলিলে এক শৃঙ্গধারী নিযুত যোজন পরিমিত শরীরের একটি স্বর্ণ বর্ণের মৎস্য ভেসে থাকতে দেখা গেল। কাছির ন্যায় দৃষ্ট বহুরূপী বাসুকির দ্বারা নৌকা এবং মৎস্যের শৃঙ্গের সঙ্গে বাঁধা হল মৎস্য অবতারের পূর্ব নির্দেশ অনুযায়ী। তারপর নৃপতি ভগবান বিষ্ণুকে স্মরণ করতে লাগলেন।

temple

রাজা সত্যব্রতের স্তবে সন্তুষ্ট হলেন তিনি। জলে ভাসমান অবস্থায় রাজাকে নানা তত্ত্বকথা শোনালেন। এইসব তত্ত্ব উপদেশকে নিয়ে লেখা হয়েছে মৎস্য পুরাণ।

এরপর ভগবান বিষ্ণু পাতালে হয়গ্রীব নামক অসুরকে বধ করে বেদ উদ্ধার করেন। ইতিমধ্যে অতীত কল্পের অবসান ঘটেছে। ব্রহ্মার নিদ্রা ভঙ্গ হয়েছে। শ্রীহরি কর্তৃক তিনি তাঁর চুরি যাওয়া বেদসকল ফিরে পেলেন। মৎস্যরূপধারী শ্রীহরির উপদেশ গাথা সম্বলিত মৎস্যপুরাণ পাঠ বা শ্রবণ করলে সকল জীবের পাপের বিনাশ ঘটে।

চৈত্র শুক্লাদি অর্থাৎ চৈত্র মাসের অমাবস্যার পরের দিন মৎস্য অবতারের আবির্ভাব ঘটেছিল। দেশে একমাত্র অন্ধ্রপ্রদেশের নাগালাপুরম গ্রামে মৎস্যাবতারের মন্দির আছে। প্রতি বছর চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষের তৃতীয়া তিথিতে সেখানে উৎসবের আয়োজিত হয়। এইদিন হিন্দুদের নিরামিষ খেতে হয়। মাছ খাওয়া যায় না। সন্ধ্যায় বিষ্ণুদেবকে অর্ঘ্য অর্পণ করতে হয়, দান করতে হয় দরিদ্রদের। এছাড়া এই দিনে দশাবতার স্তোত্র, বিষ্ণুসহস্রনাম স্তোত্র পাঠ বা শ্রবণেও মহাপুণ্য অর্জিত হয়।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...