নাগেশ্বরদেবের উৎপত্তি কথা জানেন কি?

শিব পুরাণের উনত্রিংশতি অধ্যায়ে রয়েছে দারুকা রাক্ষসীর কথা, যার একনিষ্ঠ ভক্তিতে প্রসন্ন হয়ে পার্বতী এমন বর দিয়ে বসেছিলেন যে, শিব দুর্গার মধ্যেই কলহ সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। তারপর এক আশ্চর্য‌ উপায় বের হল আর এই কলহের অবসান ঘটল। এই কলহ থেকেই আবির্ভূত হলেন জ্যোতিঃপতি নাগেশ্বরদেব। চলুন জেনে নেওয়া যাক শিব পুরাণের সেই আধ্যাত্মিক মহিমা সমন্বিত কাহিনী। 

দারুকা নামে একজন অতি বলশালী রাক্ষসী ছিল। সে ছিল দেবী পার্বতীর একনিষ্ঠ ভক্ত।‌ দেবীর বরেই সে বর লাভ করেছিল। তার স্বামী রাক্ষসরাজ দারুক ছিল অত্যন্ত বলশালী। কিন্তু সে ভক্ত ছিল না, সে দেব বিরোধী বিভিন্ন রকম কাজ করত। দারুক ঋষিদের যজ্ঞ ধ্বংস করত, ধর্মের কাজে নানাভাবে বাধা সৃষ্টি করত, মানুষের ওপর অত্যাচার করত। পশ্চিম সাগরের কাছে ষোড়শ যোজন ব্যাপৃত দারুকের একটি সমৃদ্ধ  বন ছিল দারুকের।পার্বতী একবার দারুকার ভক্তিতে প্রসন্ন হয়ে বর দিয়েছিলেন যে, "তুমি যেখানে যাবে তোমার ইচ্ছেমতো ভূমি বৃক্ষরাজি সমস্ত বস্তু সহ এই অরণ্য‌ও তোমার সঙ্গে যাবে।" সেই থেকে দারুকা রাক্ষসী যেখানে যেত, সমস্ত অরণ্য‌ও তার সঙ্গে সেখানেই যেত। রাক্ষস দারুক‌ও সেই অরণ্যের ভিতর থেকে সকলের মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি করত। 

রাক্ষস দারুকের অত্যাচার যখন ক্রমশ বাড়তে শুরু করল তখন উৎপীড়িত মানুষেরা একদিন সকলে মিলে ঔর্ব ঋষির কাছে গিয়ে নিজেদের উদ্ধারের জন্য প্রার্থনা করতে শুরু করলেন। রাক্ষসের অত্যাচারে উৎপীড়িত মানুষেরা বললেন, "হে ঋষি আমাদের রক্ষা করুন। তা না হলে এই দুষ্টু রাক্ষস আমাদের সকলকে মেরে ফেলবে। আপনার দৈব তেজ রাক্ষসরা সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে যায় একমাত্র আপনি আমাদের রক্ষা করতে পারেন। আপনি আমাদের মঙ্গল বিধানও সুখ দান করুন।"  উৎপীড়িত মানুষের মুখে রক্ষা করবার এই কাতর আর্তি শুনে ঔর্ব ঋষির মনে দয়ার সৃষ্টি হল। তিনি তখন সেই সকল মানুষদেরকে আশ্বস্ত করে বললেন, আমি তোমাদের রক্ষা করবো। এরপর তিনি রাক্ষসদের উদ্দেশ্যে শাপ দিয়ে বললেন, এইসব রাক্ষসেরা যত বড়ই হোক না কেন প্রাণী হিংসা করলে তৎক্ষণাৎ তাদের মৃত্যুর মুখে পতিত হতে হবে। যজ্ঞ ধ্বংস করল তাদের নাশ হবে। এই কথা বলেই আবার তপস্যারত হলেন ঔর্ব ঋষি। 

এই শাপ বাক্য শুনে দেবতারা খুশি হলেন, তাঁরা রাক্ষসদের সমাপ্তি ঘটানোর জন্য যুদ্ধের উদ্দেশ্যে অস্ত্র নিয়ে পৌঁছে গেলেন সেখানে, রাক্ষসেরা তখন ভাবতে থাকল যে, তারা কী করবে? কী উপায়ে বাঁচবে? তখন সমস্যার সমাধান করলেন দারুকা রাক্ষসী। তিনি বললেন, দেবী পার্বতী আমাকে বর দিয়েছিলেন, আমি যেখানে যাব এই বন‌ও সেখানে যাবে। অতএব তোমরা ভাবছো কেন? আমি এই অরণ্যকে জলের ওপর নিয়ে যাব। দেবতারা তোমাদের কিছুই করতে পারবে না। দারুকার এই কথা শুনে রাক্ষসেরা তাকে প্রণাম করে বলল, ঋষি আমাদের শাপ দিয়ে আমাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন।  তুমি আমাদের বাঁচালে। পারো তো এক্ষুনি এই বনকে জলের উপর নিয়ে চলো আমরা সেখানে গিয়ে নিরাপদে বাস করব। এমন সময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে  দেবতারা সেখানে এসে দাঁড়ালো, রাক্ষসরাজ দারুকের দ্বারা অত্যাচারিত বহু মানুষ‌ও দেবগণের সঙ্গে সেখানে এল। এই দৃশ্য দেখে দারুকা রাক্ষসী পার্বতী দেবীর স্তব করে তার বরের প্রভাবে প্রাসাদ-দুর্গ জলাশয় সহ সমস্ত বনকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে সমুদ্রের মধ্যভাগে নিয়ে স্থাপন করল।

এইভাবে দেবতাদের নাগালের থেকে অনেক দূরত্বে গিয়ে তারা সুখে শান্তিতে বাস করতে থাকল আর তারা স্থলভাগে ফিরে এল না। কিন্তু দীর্ঘকাল  ওইভাবে সমুদ্রের মধ্যে থাকার কারণে মুনীর শাপ বাক্যের কথা ভুলে গিয়ে রাক্ষসেরা আবার লোকের প্রতি অত্যাচার করতে শুরু করল। যে সমস্ত লোক নৌকায় ভ্রমণ করতে করতে নৌকাযোগে কোথাও যেত রাক্ষসেরা তাদের ধরে বধ করত অথবা তাদেরকে নিয়ে গিয়ে কারাগারে বন্দি করে রাখত। এইভাবে যে সকল নৌকারোহী লোকেদের বিভিন্ন সময়ে তারা কারাগারে বদ্ধ করে রেখেছিল তাদের মধ্যে একজন শিব ভক্ত বৈশ্য ছিল। সে ছিল বৈশ্যদের রাজা, তার নাম ছিল সুপ্রিয়। তিনি শিব পুজো না করে কোনদিন জল গ্রহণ করতেন না। তিনি কারাগারে থেকে সকল বন্দীদের শিব পুজো ও মন্ত্র সম্পর্কে উপদেশ দিয়েছিলেন। তখন তার কথা শুনে অনেকেই কারাগারের মধ্যে বসে শিব পুজো করতে শুরু করলেন। কেউ কেউ আবার পদ্মাসনে বসে বিনা উপচারে মনে মনেই পুজো করতে শুরু করলেন।  সুপ্রিয় পার্থিব শিব লিঙ্গ পুজা বিধি অনুসারে পুজো করতে লাগলেন। যারা পূজাবিধি জানত না তারা শুধুমাত্র "ওম নমঃ শিবায়" মন্ত্র দ্বারা শিবকে ধ্যান করতে শুরু করলেন। 

বৈশ্যরাজ সুপ্রিয় যখন একাগ্রচিত্তে শিবের ধ্যান করে পূজা করতেন তখন তার উপর প্রসন্ন হয় শিব তার প্রদত্ত সমস্ত উপাচার গ্রহণ করতেন সুপ্রিয় তা জানতে পারতেন না। শিব প্রতিদিনই তার প্রদত্ত উপাচারগুলি নিজের হাতে গ্রহণ করতেন। এইভাবে ছয় মাস অতিবাহিত হওয়ার পর একদিন সুপ্রিয়ের কাছে  শিবের  সুন্দর মূর্তি দেখে রাজভৃত্যরা রাক্ষসরাজ দারুকের কাছে এই কথা জানাল। এরপর রাক্ষসরাজ সুপ্রিয়ের কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, "বৈশ্য তুমি কার পুজা করছ?" সুপ্রিয় তখন বলল, "হে রাক্ষস তুমি তো সব জানো।" এই কথা শুনে রাক্ষসরাজ  তার অনুচরদের বলল, "তোমরা এইসব লোকেদের বিনাশ করো।" তখন রাক্ষসেরা কারারুদ্ধ লোকেদের বধ করতে উদ্যত হল। বৈশ্য রাজ সুপ্রিয় তখন অস্ত্র নিয়ে রাক্ষসদের আসতে দেখে বললেন, “হে দেবেশ আমাদের এই বিপদ থেকে রক্ষা করুন। তুমি আমার যথাসর্বস্ব ও একমাত্র অবলম্বন”। ভক্তের কাতর প্রার্থনা শুনে ভগবান তখন জ্যোতির্ময় শিবলিঙ্গ রূপে উত্থিত হলেন। সুপ্রিয় মহাদেবকে পুজো করতে শুরু করল।  শিব তখন ভক্তের পূজায় প্রসন্ন হয়ে সুপ্রিয়কে পাশুপাত অস্ত্র দান করলেন এবং তিনি রাক্ষসরাজ সমেত অন্যান্য সকল রাক্ষসদের বধ করলেন।

এরপর দেবাদিদেব মহাদেব সুপ্রিয়কে বললেন, “ এই বনে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র চার বর্ণের লোক বাস করবে এবং তারা নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে এখানে অনেক তপস্যা হবে এবং এখানে অনেক মুনির এই আগমন হবে”। অন্যদিকে রাক্ষসদের এরকম বিপদ দেখে রাক্ষসী দারুকা দেবী পার্বতীর স্তব শুরু করলেন। দেবী তাকে বললেন, “ আমি কী করবো?” দারুকা দেবীকে বললেন, “আপনি আমার বংশ রক্ষা করুন”। দেবী  তখন বললেন, "আমি তোমার বংশ রক্ষা করব সত্য বলছি। "- এইবার শুরু হলো দেবীর সঙ্গে দেবাদিদেব মহাদেবের কলহ।

দেবাদিদেব মহাদেব রেগে গিয়ে বললেন, “ তোমার যা ইচ্ছা হয় করো”। দেবী পার্বতী তখন বললেন, “আমার কথা শোনো যুগ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই হিংসাশ্রয়ী তামসিক ভাব' বিরাজ করুক তা না হলে প্রলয় হবে না। যুগ শেষ হলে তোমার প্রদত্ত বর সফল হবে।  আমার বলে বলীয়ান হয়ে রাক্ষসী দারুকা রাক্ষসদের রানী রূপে রাজ্য শাসন করবে এই সকল রাক্ষস পত্নীগণ পুত্র প্রসব করবে, এরা সকলে বনে বাস করবে এই আমার অভিপ্রায়”।

তখন শিব বললেন, “আমি ভক্ত পালনের জন্য এই বনেই থাকবো। স্বধর্মনিষ্ঠ  যে কোনো বর্ণের লোক আমার এই মূর্তি দর্শন করলে চক্রবর্তী হবে।কলিযুগের অবসানের পর সত্যযুগ শুরু হলে মহাসেনের পুত্র বীরসেন আমাকে দর্শন করে চক্রবর্তী হবে”। এরপর হর‌-পার্বতী উভয়েই হাস্য পরিহাস করে সেখানে অবস্থান করতে লাগলেন। 

এই বনে স্থাপিত শিব মূর্তির নাম নাগেশ। এরপর মহাসেনের পুত্র বীর সেন ১২ বছর  ধরে পার্থিব ও শিবলিঙ্গের পূজা করে পরম দুষ্কর তপস্যা করলেন এরপর একদিন দেবাদিদেব মহাদেব তাঁর সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে বললেন, “আমি তোমাকে এরূপ ধাতু লিপ্ত কাষ্ঠময় মৎস্যী প্রদান করবো ওই  মৎস্যী হলেন সাক্ষাৎ যোগমায়া। তুমি তখন তা নিয়ে নৌকাযোগে দারুকা বনে যাবে। সেখানে গিয়ে তুমি আমার দ্বারকৃত গর্তের মধ্যে দিয়ে সেই স্থানে গিয়ে নাগেশ্বরের পূজা করে পাশুপাত অস্ত্র লাভ করবে। তারপর সেই রাজ্যের রাক্ষস ও রাক্ষসীদের বধ করবে। আমাকে দর্শন করতে তোমার আর কোনো অসুবিধা থাকবে না”।

এই ভাবেই জ্যোতিঃপতি নাগেশ্বরদেব আবির্ভূত হয়েছিলেন। শিবপুরাণে এই কাহিনি পাঠের মাহাত্ম্য হিসেবে বলা আছে,  এই কাহিনী শ্রবণ করলে মানুষের মহাপাপের থেকে মুক্তিলাভ হয়।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...