বিশ্বকর্মা হলেন স্বর্গের দেবশিল্পী। তিনি দিব্য বিমান, দিব্য অস্ত্র থেকে শুরু করে দেবপুরী অবধি নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়া তিনি অলংকার, আয়ুধ ইত্যাদি প্রস্তুত করেছেন। দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার পিতা প্রভাস হলেন অষ্টবসুর একজন আর বিশ্বকর্মার মাতা যোগসিদ্ধা হলেন দেবগুরু বৃহস্পতির ভগিনী। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বলা হয় ব্রহ্মার নাভি থেকে বিশ্বকর্মার সৃষ্টি।
ধ্যানমন্ত্রে বিশ্বকর্মা সম্পর্কে বলা হয়েছে, হে দংশপাল (বর্মের দ্বারা পালনকারী) হে মহাবীর, হে বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ও বিশ্ব বিধাতা, হে সুন্দর চিত্র রূপ কর্ম কারক, আপনি মাল্য চন্দন ধারণ করে থাকেন।অন্যদিকে বিশ্বকর্মার প্রণাম মন্ত্রে বলা হয়েছে, দেবশিল্পী, মহাভাগ (অর্থাৎ দয়াদি অষ্ট গুণযুক্ত) দেবতাদের কারুকার্য্যসাধক সর্বাভীষ্ট প্রদানকারী হে বিশ্বকর্মা আপনাকে নমস্কার। অর্থাৎ ধ্যান ও প্রণাম মন্ত্র অনুযায়ী বিশ্বকর্মার যে পরিচয় পাওয়া গেলো, তাতে দেখা যাচ্ছে তিনি মহাবীর, তিনিই বিশ্বের বিধাতা, তিনিই আবার দয়াদি অষ্টগুণ যুক্ত। তিনি সৃষ্টিকর্তা, তিনি কারুকার্যের দেবতা অর্থাৎ কর্মের দেবতা আবার তিনি সকলের অভিষ্ঠ প্রদান করেন।
বিশ্বকর্মার সৃষ্টি
অগস্ত্য মুনির ভবন থেকে শুরু করে কুবেরের অলকাপুরী, দিব্য বিমান, রাবণের স্বর্ণলঙ্কা, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকাপুরী এমনকি জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার শ্রীবিগ্রহ পর্যন্ত বিশ্বকর্মার সৃষ্টি। রাবনের রাজপ্রাসাদের সাথে সুন্দর বাগান, গোষ্ঠ, মনোরম ক্রীড়া স্থান, মন্ত্রণাগৃহ, রাজ প্রাসাদের কারুকার্য সবকিছুই দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার নিখুঁত শিল্পকলাকেই ফুটিয়ে তোলে। মৎস্য পুরাণে বলা হয়, কূপ-প্রতিমা-গৃহ-উদ্যান সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেন বিশ্বকর্মা। দেবতারা যে বিমানে চড়ে যাতায়াত করেন,যে অস্ত্র সকল ব্যবহার করেন, সেগুলিও বিশ্বকর্মারই সৃষ্টি। দধীচি মুনির অস্থি থেকে বিশ্বকর্মাই বজ্র নির্মাণ করে ইন্দ্রকে প্রদান করে ছিলেন বৃত্রাসুর বধের জন্য, আবার নারায়ণের চক্র, থেকে মহাদেবের ত্রিশূল, মহামায়ার তীক্ষ বর্শা, অভেদ্য কবচ সহ সকল মারণাস্ত্রই বিশ্বকর্মার নির্মাণ।
রামসেতু থেকে অসুরদের অস্ত্রশিল্পী বিশ্বকর্মা পুত্র
রামায়ণে রামচন্দ্রের সেতু বন্ধন করা শিল্পী নল ছিলেন বিশ্বকর্মার পুত্র। বায়ুপুরাণ ও পদ্মপুরাণে বলা হয়, ভক্ত প্রহ্লাদের কন্যা বিরোচনার সাথে বিশ্বকর্মার বিবাহের পর তাদের সন্তান ময়দানব ছিলো অসুরদের শিল্পী।
মর্ত্যে চিত্রকর, স্বর্ণকর থেকে শুরু করে সকল শিল্পী বিশ্বকর্মার পুত্র
মর্ত্যলোকে কর্মকার, কুম্ভকার, স্বর্ণকার থেকে শুরু করে সকলেই হলেন বিশ্বকর্মার বংশধর। এই প্রসঙ্গে একটি গল্প প্রচলিত আছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বলা হয়েছে যে, বিশ্বকর্মা ও তার স্ত্রী ঘৃতাচী দুজনেই শাপগ্রস্ত হয়ে মর্তলোকে অবতীর্ণ হন। মর্ত্যলোকে জন্মগ্রহণ করার পর তাদের নয়টি সন্তানের জন্ম হয়। এই নয়টি সন্তান হলো-মালাকার, কর্মকার, কাংস্যকার, শঙ্খকার,সূত্রধর,কুবিন্দক,কুম্ভকার, স্বর্ণকার,চিত্রকর। বিশ্বকর্মা তার প্রত্যেকটি সন্তানকেই শিল্পকর্ম শেখান। মালাকারকে তিনি পুষ্প শিল্প শিখিয়েছিলেন, কর্মকারকে শিখিয়েছিলেন লৌহ শিল্প, কাংস্যকারকে শিখিয়েছিলেন কাঁসার শিল্প, শঙ্খকারকে শঙ্খ শিল্প শেখান, সূত্রধরকে শিখিয়েছিলেন কাষ্ঠ শিল্প। কুবিন্দককে বয়ন শিল্প শিখিয়েছিলেন, কুম্ভকারকে মৃৎশিল্প শিখিয়েছিলেন, স্বর্ণকারকে শিখিয়েছিলেন অলঙ্কার শিল্প আর চিত্রকরকে অঙ্কন শিল্প শিখিয়েছিলেন।
দেবশিল্পী থেকে বানর
বিশ্বকর্মা ও ঘৃতাচীর মেয়ে চিত্রাঙ্গদা পৃথিবীর সূর্য বংশের রাজা সুরথকে ভালোবাসতো। দেবতা আর মানুষের মধ্যে বিবাহ হয় না, তাই বিশ্বকর্মা পুরো বিষয়টি জানতে পেরে মেয়েকে শাসন করেন। কিন্তু শাসনে কোনো ফল হলো না। বিশ্বকর্মার মেয়ে স্বর্গ থেকে পালালো তারপর সুরথকে বিয়ে করে নিলো। এই ঘটনায় অত্যন্ত রেগে গেলেন বিশ্বকর্মা, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। তিনি মেয়ের কাছে যান, বাবাকে দেখে মেয়ে ভাবে বাবা বোধহয় তাদেরকে আশীর্বাদ করতে আসছেন। কিন্তু ফল হলো বিপরীত। বিশ্বকর্মা আশীর্বাদের পরিবর্তে মেয়েকে অভিশাপ দিলেন, কন্যার বিবাহ বিচ্ছেদের অভিশাপ। আমাদের সনাতন ধর্মে বিবাহকে খুব পবিত্র হিসেবে মানা হয়, সেখানে বিবাহবিচ্ছেদের কোন স্থান নেই। তাই বিশ্বকর্মার এহেন আচরণে মহর্ষি ঋতধ্বজ ভাবলেন, দেবতা হয়ে বিশ্বকর্মার একি পশুর মত বুদ্ধি হলো? কন্যার সাথে পশুর মত আচরণের জন্য মুনি তাই বিশ্বকর্মাকে বানর হয়ে জন্মাবার অভিশাপ দিলেন। বিশ্বকর্মা বানর হয়ে মর্তলোকে জন্মালেন। অবশেষে একসময় কন্যার বিবাহ মেনে নিলেন তিনি এবং তার পর কন্যা ও বিশ্বকর্মা দুজনেই শাপ থেকে মুক্ত হলেন।
হস্তী কেন বিশ্বকর্মার বাহন?
বিশ্বকর্মার মূর্তি যদি আমরা দেখি তাহলে দেখতে পাবো, সেখানে বিশ্বকর্মার বাহন হিসেবে হাতিকে দেখতে পাওয়া যায়। কলকাতার কর্মকার সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট নেতা স্বর্গত হরষিত কেশরী রায় বিশ্বকর্মার হস্তী বাহন বিগ্রহের পুজো করেন। হাতি কেন বিশ্বকর্মার বাহন? এর উত্তরে বলা যায়, হাতির একটি শুন্ড বা কর আছে। এই কর থাকার কারণেই তাকে করী বলে। কর শব্দটির সৃষ্টি সংস্কৃতের কৃ ধাতু থেকে। এই ধাতুর দ্বারা যাবতীয় কর্ম বোঝায়। আবার হাতিও তার শুন্ডের সাহায্য নিয়ে গাছের ডাল টানে, জল খায়, স্নান করে। অন্যদিকে বিশ্বকর্মার যাবতীয় শিল্পের মধ্য দিয়েই কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। তাই বিশ্বকর্মা যেমন কর্মের দেবতা রূপে পূজিত হন তেমনি শুন্ড দ্বারা কর্ম করা হাতি বিশ্বকর্মার বাহন হিসেবে যথার্থ।
বিশ্বকর্মার হাতে দাঁড়িপাল্লা সঠিক জীবনযাপনের শিক্ষা দেয়
বাঙালি হিন্দুদের বিশ্বকর্মা মূর্তিতে দেখা যায় বিশ্বকর্মার চারটি হাত। তার চার হাতে দাঁড়িপাল্লা, হাতুরী, ছেনী ও কুঠার থাকে। বিশ্বকর্মা শিল্পের দেবতা তাই তিনি এগুলি ধারণ করেন। বিশ্বকর্মার হাতে থাকা দাঁড়িপাল্লা আবার অনেকখানি প্রতীকস্বরূপ। দাঁড়িপাল্লার মধ্যে দুটি সমান ওজনের পাল্লা থাকে, অপরের মাথার সূচক যখন সমানভাবে ঊর্ধ্বমুখী হয়, তখন বোঝা যায় মাপ সমান হয়েছে। এইভাবে একটি পাল্লাতে বাটখারা রেখে ও অপরটিতে দ্রব্য রেখে পরিমাপ করা হয়। এই দাঁড়িপাল্লার মত আমাদের জীবনকে ও ঠিক একটি আত্মিক বিন্দুতে স্থির রাখা উচিত। আবার দাঁড়িপাল্লার দুটি পাল্লা জ্ঞান ও কর্মকে বোঝায়। জ্ঞানের দিকে যদি কেউ বেশি গুরুত্ব দিয়ে কর্মকে অবহেলা করে, তবে তার পরিনামে তাকে যেমন দুঃখ ভোগ করতে হবে ঠিক তেমনি কর্মের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ে কেউ যদি জ্ঞানকে অবহেলা করে তাহলে আধ্যাত্মিক অকল্যাণ তাকে ঘিরে ফেলবে। তাই ঞ্জান ও কর্ম দুটিকেই সমানভাবে সঙ্গে নিয়ে জীবনে এগিয়ে চলতে হবে।