ভক্তের মহিমা প্রকাশ করবার জন্য দেবতা তাকে দুঃখ দেয় বারবার, তার ধৈর্য শক্তির পরীক্ষা নেন, আবার ভক্তের বিপদ দেখে নিজে ভক্তকে রক্ষা করতে ছুটে আসেন ছদ্মবেশে। কখনও আবার ছদ্মবেশে তার সঙ্গে যুদ্ধ করে ভক্তের যশ প্রতিষ্ঠা করে। এই কারণেই ভগবানকে দয়াময় বলা হয়।
শিব পুরাণ নিয়ে পড়তে গিয়ে একাধিকবার দেখেছি দেবাদিদেব শিবকে ভগবান বলা হয়েছে এবং নারায়ণ অথবা কৃষ্ণকে তার অবতার অংশ বলা হয়েছে। অন্যদিকে বিষ্ণুপুরাণে বলা হয়েছে ভগবান একজনই তিনি নারায়ণ, তিনি বিষ্ণু, তিনি কৃষ্ণ। এই মতভেদের মধ্যে না জড়িয়ে আমরা একটি স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে, হরি, হর একে অন্যের পরিপূরক, তারা প্রাণপ্রিয় বন্ধু এবং একজন অন্যজনের লীলা বিস্তারের সহায়ক হয়েছেন। যখন যার মাহাত্ম্যকথা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখন অন্যজন ছোট হয়ে অপরের মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা করেছেন, এমনটা বুঝতে পারলেই আমরা আধ্যাত্মিক কাহিনির মধ্যে থাকা সত্যকেও অনুধাবন করতে পারব।
মহাভারতের যুদ্ধের পিছনে লীলাময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অবদানই সব বলে বর্ণনা করা হয়েছে মহাভারতে আবার বিষ্ণুপুরাণাদিতেও তাই বলা হয়েছে, কিন্তু যখন আমরা শিব পুরাণ পাঠ করব, তখন দেখব মহাভারতে অর্জুনের যুদ্ধে জয়লাভ এবং দুর্যোধনের পরাজয়ের পেছনে দেবাদিদেব মহাদেবের অবদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এবং শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং নিজেকে দেবাদিদেবের অবতার বলে উল্লেখ করে তার মহিমা কীর্তন করেছেন।
আজ বলব, দেবাদিদেব মহাদেব কীভাবে অর্জুনের ধৈর্যের পরীক্ষা নিয়ে এবং ব্যাধবেশে তার সামনে আবির্ভূত হয়ে তার সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন এবং সবশেষে তাকে পাশুপাত অস্ত্র প্রদান করে যুদ্ধে অজেয় হওয়ার বর প্রদান করেছিলেন। শিব পুরাণের জ্ঞান সংহিতার অন্তর্গত 'শিব অর্জুন যুদ্ধ কথা' অধ্যায়ে এই কাহিনী বিশদে বর্ণিত আছে।
একবার মূক নামের এক দৈত্য বরাহবেশ ধারণ করে অর্জুনের সামনে উপস্থিত হয়। এই দৈত্যকে দুর্যোধনই অর্জুনের কাছে পাঠিয়েছিলেন। সেই বরাহ রীতিমতো হুংকার করতে করতে অর্জুনের সম্মুখে এসে উপস্থিত হলে অর্জুন তাকে বধ করায় কর্তব্য বলে মনে করল। এইসময় দেবাদিদেব মহাদেবও তার একজন পারিষদকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাধের রূপে সেখানে এসে হাজির হলেন। এরপর অর্জুন এবং ব্যাধরূপী মহাদেব দুজনে মিলে বরাহরূপী দৈত্যকে বধ করলেন। অর্জুনের বাণ বরাহের মুখ বিদ্ধ করল এবং ব্যাধের বাণ বরাহের পুচ্ছদেশ বিদ্ধ করল। অর্জুনের বাণ শূকরের মুখবিবর থেকে পুচ্ছদেশ ভেদ করে মাটিতে পড়ে গেল আর ব্যাধ রূপী শিবের বাণ শূকরের পুচ্ছদেশে গিয়ে প্রবেশ করে তার দেহ ভেদ করে মুখ দিয়ে বের হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।
শূকরটি তৎক্ষণাৎ দৈত্য রূপ ধারণ করে প্রাণ ত্যাগ করল, দৈত্যের ভীষণ রূপ দেখে শিব ও অর্জুন দুজনে সন্তুষ্ট হলেন। অর্জুন তখন মনে মনে বললেন দেবাদিদেব মহাদেবের কৃপাতেই এই দুষ্কার কার্য সাধিত হয়েছে তবে অর্জুন তখনও দেবাদিদেব মহাদেবের যথার্থ পরিচয় পাননি। ব্যাধ বেশে দেবাদিদেব যে তার সম্মুখে উপস্থিত থেকে তার শত্রু শূকররূপী দৈত্যকে বধ করলেন তা তিনি বুঝতে পারেননি। ঋষিদের এই দৈত্য বধ কাহিনী বলবার পর সূত বললেন, বরাহররূপী দৈত্য নিহত হলেও অর্জুন তখনও পর্যন্ত ব্যাধ রূপী শিবের যথার্থ পরিচয় পাননি। তখন ব্যাধরূপী শিব তাঁর একজন অনুচর ব্যাধকে তাঁর নিক্ষিপ্ত বাণ কুড়িয়ে আনতে বললেন। তখন অর্জুনও তাঁর নিক্ষিপ্ত বাণ কুড়িয়ে আনতে গেলেন।
কিন্তু সেই ব্যাধরূপী শিবের অনুচর অর্জুনকে বলল, এই বাণ দুটি আমার প্রভুর। অর্জুন বললেন, এর মধ্যে একটি বাণ আমার এবং বাণের শেষ প্রান্তে ময়ূরপুচ্ছ আছে এবং আমার নামও অঙ্কিত আছে। কিন্তু ব্যাধ একথা মানতে চাইল না। সে বলল, তুমি মিথ্যা কথা বলছ। আমার প্রভু এই সব ব্যাধদের দলপতি। এই দুটি বাণই তাঁর। তুমি তপস্বী হয়েও মিথ্যা বলছ। তুমি কৃতঘ্ন। আমার প্রভু দৈত্য বধ করে তোমাকে রক্ষা করেছেন। তিনি তোমার উপকারী। তথাপি তুমি তার বস্তু হরণ করবার চেষ্টা করছে। তবে এই বাণ যদি তোমার একান্ত প্রয়োজন থাকে তাহলে আমার প্রভুর কাছে চলো আমার প্রভুর কাছে চলো প্রার্থনা করো তিনি তাহলে তা তোমাকে দান করবেন।”
অর্জুন এইসব কথা শুনেও বুঝতে পারলেন না দেবাদিদেব মহাদেব তার পরীক্ষা নেওয়ার জন্যই এই সমস্ত কিছু করেছেন। তিনি এই সব কথা শুনে ক্ষাত্র তেজে উজ্জ্বল হয়ে বললেন, “এ বাণ আমার, আমি ক্ষত্রিয়, আমরা মিথ্যা কথা বলি না। আমরা কারও কোন বস্তু অপহরণ করি না। আমরা কাউকে যুদ্ধে পরাজিত করে তার বস্তু গ্রহণ করি, তোমরা বনচর ব্যাধ, চৌর্যবৃত্তি তোমাদের স্বভাব। আমি তোমাদের রাজার কাছে যাব না। সে তো তোমাদের মতই ব্যাধ তার যদি প্রয়োজন থাকে, সে আমার কাছে এসে চাইলেই আমি তাকে তা দেব। আমাদের অনেক বাণ আছে। তোমার মিথ্যা বলার জন্য এখনি তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করতাম কিন্তু যুদ্ধে তুমি আমার সমকক্ষ নও। সমানে সমানে যুদ্ধ হয়। এখন আমার বাণ আমার কাছেই থাকবে, তোমার প্রভুকে ডাক। সে এসে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করে এ বাণ নিয়ে যাক, কিন্তু জানবে তোমাদের রাজা সামান্য ব্যাধমাত্র, আমার সমকক্ষ যোদ্ধা নয়।”
অর্জুন বললেন, “তোমার প্রভু এসে আমার সঙ্গে যুদ্ধ করে আমাকে পরাজিত করে বাণ গ্রহণ করুক না হলে আমি আমার বাণ অবশ্যই গ্রহণ করব। এখন যা ইচ্ছা তা কর।”
এরপর সেই অনুচর ব্যাধ ব্যাধরূপী মহাদেবের কাছে গিয়ে সব কথা জানালে ভিল্লরূপী মহাদেব তাঁর ভিল্ল সেনাদের নিয়ে অর্জুনের কাছে গিয়ে তাকে বললেন, “তুমি বাণ পরিত্যাগ করে চলে যাও। কেন সামান্য একটা বাণের জন্য যুদ্ধে প্রাণ ত্যাগ করবে। তুমি প্রাণত্যাগ করলে তোমার স্ত্রী ও ভ্রাতারা শোকে মুহ্যমান হবে। “অর্জুন তখন সেই ব্যাধ রাজকে বললেন, “ আমি ক্ষত্রিয়। এই বাণ যুদ্ধভয়ে পরিত্যাগ করলে আমার কুল- গৌরব নাশ হবে। আমার ভাইরা দুঃখিত হবেন। আমার যুদ্ধবিদ্যা নিষ্ফল হবে।”
শিব অর্জুনের যুদ্ধ শিব পুরাণের যেভাবে বর্ণিত আছে,সেই কথায় বলছি। সূত বললেন, "অর্জুন সেই ব্যাধরাজকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে দেখে শিবের ধ্যান করে যুদ্ধ শুরু করলেন। ব্যাধরূপী শিবও অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। প্রথমে ব্যাধ সেনাগণ অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করল। অর্জুন তাদের নিক্ষিপ্ত সকল অস্ত্র একে একে খণ্ডন করে তাদের উপর বাণ বর্ষণ করতে থাকলে তারা পীড়িত হয়ে পালিয়ে গেল। তখন অর্জুন কিরাতরূপী শিবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। শিব তাঁর সকল অস্ত্র ব্যর্থ করে তাঁর বর্ম ছেদন করলেন। অর্জুন তখন ব্যাধরূপী শিবের সঙ্গে মল্লযুদ্ধ করতে লাগলেন। শিব আকাশে উঠে গেলে অর্জুন ও আকাশে উঠে গিয়ে শিবের পা ধরে তাকে ঘোরাতে লাগলেন। পরে শিব অর্জুনের হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে তার যথার্থ রূপ দর্শন করালেন।”
ব্যাধের আসল রূপ দেখে অর্জুন লজ্জিত হলেন। তিনি শিবের চরণ ধরে বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করতে শুরু করলেন। তিনি বলতে থাকলেন, “আমি না জেনে অন্যায় করে ফেলেছি।" শিব তখন অর্জুনের হাত ধরে বললেন, “হে অর্জুন তুমি আমার ভক্ত। তোমাকে পরীক্ষা করার জন্যই আমি এই ছদ্মরূপ ধারণ করেছিলাম, এখনও ওঠো শোক পরিত্যাগ করো। আমি প্রসন্ন হয়েছি অতএব বর গ্রহণ করো। তুমি আমার ওপর যে অস্ত্র নিক্ষেপ করেছ আমি তা পূজা রূপে গ্রহণ করেছি। শত্রুগণের নিকট যশ বিস্তারের জন্য আমি এই কাজ করেছি। দুঃখ করো না।”
অর্জুন ব্যাধরূপী শিবকে দেখে এরপর ভক্তি ভরে শিবের স্তব করতে শুরু করলেন। তিনি বললেন, “হে দেবাদিদেব মহাদেব। তুমি সদাশিব মুক্তিদাতা তোমাকে নমস্কার।” শিব তখন অর্জুনকে বর প্রার্থনা করতে বললেন। অর্জুন তখন বললেন, “হে প্রভু শত্রুভয় থেকে মুক্ত করে শত্রু জয় করে ইহলোকে যাতে যশ প্রাপ্ত হই এই বর প্রদান করুন।”
শিব তখন অর্জুনকে পাশুপত অস্ত্র দান করে বললেন, “তুমি ব্রহ্মাণ্ডে অজেয় হবে। এই অস্ত্র দ্বারা শত্রুদের জয় করে শুভ ফল ভোগ করবে। আমি কৃষ্ণকে বলে দেবো, তিনি আমার অংশ। তিনি তোমায় সাহায্য করবেন।” এই সকল কথা বলে শিব অর্জুনের মস্তকে হাত রেখে তাঁকে আশীর্বাদ করে অন্তর্হিত হলেন।
এরপর অর্জুন আশ্রমে ফিরে এলেন, যেখানে তাঁরা দ্রৌপদীসহ পঞ্চ পান্ডব অবস্থান করছিলেন। অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে প্রণাম করলেন এবং তাঁকে সমস্ত কথা সবিস্তারে খুলে বললেন।
অর্জুন দেবাদিদেবের সঙ্গে যুদ্ধ করে পাশুপাত অস্ত্র লাভ করেছেন শুনবার পর দেবগন আনন্দিত হয়ে তাদের আপন অস্ত্র অর্জুনকে দান করলেন। এরপর পাণ্ডবেরা সকলে মিলে দেবাদিদেব মহাদেবের আরাধনা করতে লাগলেন। অর্জুন শিবের তপস্যা করে ফিরে এসেছেন জেনে কৃষ্ণ সেখানে সেই আশ্রমে এলেন ও বললেন, “শংকরই তোমাদের সকল দুঃখ দূর করবেন। আমি শঙ্করের আরাধনা করে থাকি”। এই কথা বলে কৃষ্ণ দ্বারকাতে চলে গেলেন।