দশমীতেই শেষ হয় উৎসব। সর্বজনীন শারদ উৎসবগুলিতে এক রকমভাবে বিসর্জন হয়। আবার বনেদি বাড়ির ক্ষেত্রে নিয়ম আলাদা। দশমীর তিথি পড়লেই বিষাদ নেমে আসে। দশমীর দিন সিঁদুর খেলার পর রয়েছে কনকাঞ্জলির চল। তারপর দেবী দুর্গা আমাদের ঘরের মেয়ে উমার আজ ফেরার পালা। বাঙালির জীবনে বিজয়া দশমী বিষাদের বার্তা নিয়ে আসে। কিন্তু দশমীর দিনের মধ্যেও রয়েছে কিছু পৌরাণিক তাৎপর্য।
'বিজয়া দশমী', 'বিজয়া' ও 'দশমী' দুটি শব্দ মিলে দশমী শব্দের জন্ম। দশমী অর্থাৎ আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের দশমী তিথি, যে তিথিতে পিতৃ গৃহ ছেড়ে কৈলাসে স্বামীগৃহে পাড়ি দেন দেবী। তবে তিথিটিকে 'বিজয়া দশমী' বলার কারণের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে পৌরাণিক ইতিহাস। আমাদের ফিরে যেতে হয় পুরাণে, মহিষাসুর বধ কাহিনীতে বলা হয়েছে, মহিষাসুরের সঙ্গে ৯ দিন ৯ রাত্রি যুদ্ধ করার পর দশম দিনে তাঁর বিরুদ্ধে জয় লাভ করেছিলেন মা দুর্গা। সেখান থেকেই বিজয়া শব্দের জন্ম। এছাড়াও শ্রীশ্রীচণ্ডী কাহিনী অনুসারে, দেবীর আবির্ভাব হয় আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে। শুক্লা দশমীতে তিনি মহিষাসুর বধ করেছিলেন। তাই দশমীকেই বিজয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
মার্কণ্ডেয় পুরাণও প্রায় একই কথা বলছে। আশ্বিন মাসের শুক্লা চতুর্দশীতে দেবী দুর্গা আবির্ভূতা হয়েছিলেন এবং টানা নয়দিন নয়রাত্রি ধরে মহিষাসুরের সাথে যুদ্ধের পর এই দশমীর দিনেই তিনি মহিষাসুরকে বধ করেন। শুভ শক্তির জয় হয় দশমী তিথিতে। তাই একে বিজয়া দশমী বলা হয়ে থাকে। দুই মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারতে দশমী তিথি পালনের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। রামায়ণের রয়েছে, রাবণকে পরাস্ত করে যখন রামচন্দ্র সীতাকে নিয়ে অযোধ্যায় ফিরে এলেন, সেই দিনটিকে এই দশমীর সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। উত্তর ভারত, মধ্য ভারত এবং পশ্চিম ভারতে এই দশমীর দিনটিকে 'দশেরা' হিসেবে পালন করা হয়। 'দশেরা' শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ 'দশহর' থেকে। যার অর্থ দশানন রাবণের মৃত্যু। প্রচলিত পৌরাণিক ইতিহাস অনুযায়ী, দশেরার দিন রামচন্দ্র অশুভ শক্তির প্রতীক রাবণের মাথা কেটে তাকে পরাজিত করেছিলেন। বাল্মীকি রামায়ণে বলা হয়েছে, আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমী তিথিতেই লঙ্কেশ্বর রাবণকে বধ করেছিলেন রাম। কথিত আছে, রাবণ বধের পরে আশ্বিন মাসের ৩০ তম দিনে অযোধ্যা প্রত্যাবর্তন করেন রাম, সীতা, ও লক্ষণ।
মহাভারতের বিরাট পর্বে দেখা যায়, পাণ্ডবেরা চোদ্দো বছর বনবাসের পরে এক বছরের অজ্ঞাতবাসের সময় বিরাট রাজার রাজ্যে পরিচয় বদলে ছদ্মনামে বসবাস করছিলেন। এই সময় কীচক দ্রৌপদীকে লাঞ্ছনা করায় ভীম তাঁকে হত্যা করে ফেলেন এবং এই সংবাদ দুর্যোধন কোনভাবে জানতে পেরে অনুমান করেন বিরাট রাজ্যেই পাণ্ডবেরা লুকিয়ে আছে। তাই কৌরবেরা সসৈন্যে বিরাট রাজ্য আক্রমণ করে বসেন। বিরাট রাজার পুত্র উত্তর বৃহন্নলারূপী অর্জুনকে নিয়ে শমী গাছের নীচে গিয়ে অস্ত্র সংগ্রহ করেন। তখনই উত্তর সব ঘটনা জানতে পারেন। কুরুবাহিনীর সঙ্গে অর্জুন একা লড়েন। অর্জুন মহাশক্তিতে বলীয়ান হয়ে তাদের প্রত্যেককে পরাজিত করেন।মহাসম্মোহন অস্ত্র প্রয়োগ করে তিনি সমস্ত কুরু সৈন্যকে ঘুম পাড়িয়ে দেন। কিছু কিছু পৌরাণিক ব্যাখ্যায় বলা হয়, অর্জুনের এই বিজয়ের দিনটি এবং রামচন্দ্রের বিজয়ের দিনটি একই। রামচন্দ্রের মতোই অর্জুনেরও জয়ের সূচক বিজয়া দশমী। জয় থেকেই বিজয়া এসেছে। বাঙালিরা এদিন বিষাদে পালন করে থাকেন। মা দুর্গাকে বরণ, তারপর শোভাযাত্রার মাধ্যমে বিসর্জন। মাঝে চলে সিঁদুর খেলা, একে অপরকে মিষ্টি খাওয়ানো। প্রতিমার বিসর্জন শেষে বাড়ি ফিরে পরিবার-পরিজনদের মধ্যে বাঙালিরা মেতে ওঠে পারস্পরিক আলিঙ্গনে। ছোটোরা গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেন, সমবয়সীরা আলিঙ্গন করেন আর গুরুজনেরাও ছোটদের প্রাণভরে আশীর্বাদ করেন। আবার শুরু হয় প্রতীক্ষা। দশমী মানেই সর্বত্র বিদায়ের সুর। উমা কৈলাস রওনা দেন। তবে এদিনেই দুর্গার আরও এক রূপে পূজিত হন দেবী দুর্গা। বিসর্জনের পর হয় বোধন, শারদীয়ার পর পুজিত হন দেবী অপরাজিতা। 'অপরাজিতা' দেবী দুর্গারই আরেক রূপ। বিজয়লাভের সঙ্কল্প নিয়ে অপরাজিতা পুজো হয়।
কথিত রয়েছে, সেকালের রাজারা শরৎকালে নবরাত্রি ব্রতের পরে বিজয়া দশমীতে যুদ্ধ যাত্রা করতেন। বিজয়ী হতেই নবরাত্রির পর বিজয়া দশমীর দিন রাজারা যুদ্ধযাত্রা করতেন। যুদ্ধের জন্য এই সময়টাকেই বেছে নেওয়ার কারণও ছিল। প্রথমত, চাণক্য বা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী এই সময়টাই যুদ্ধযাত্রার শ্রেষ্ঠ ও আদৰ্শ সময়। পণ্ডিত রঘুনন্দন তাঁর তিথিতত্ত্ব গ্রন্থেও সেই কথা বলেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, রাজা যদি দশমীর পর যুদ্ধযাত্রা করেন, তাহলে তার পরাজয় হয় না। তাই অপরাজেয় থাকতে এদিন যুদ্ধযাত্রা করতেন রাজারা। বিজয়লক্ষীকে বরণের প্রত্যাশা নিয়েই অপরাজিতা থেকে করা হত।
এদিন সাদা অপরাজিতা গাছকে পুজো করা হয়। গাছটিকে দেবীরূপে কল্পনা করে ফুল, বেলপাতা দিয়ে পুজো করা হয়। অনেকে আবার ঘটস্থাপন করেও পুজো করেন। পুজোর ফল লাভের জন্য হাতে অপরাজিতা লতা বাঁধার রীতিও রয়েছে। এদিন দেবীর কাছে প্রার্থনা করা হয়, হে অপরাজিতা দেবি, তুমি সর্বদা আমার বিজয় বর্ধন কর। আমার মঙ্গল ও বিজয় লাভের জন্য আমি দক্ষিণ হাতে তোমাকে ধারণ করছি। তুমি শত্রু নাশ করে নানা সমৃদ্ধির সহিত আমাকে বিজয় দান কর। রামচন্দ্র যেমন রাবণের উপর বিজয় লাভ করেছিলেন, আমারও যেন সেইরূপ জয় লাভ হয়। জীবন যুদ্ধে সারাবছর যেন আমরা অপরাজেয় থাকতে পারি, এই লক্ষ্যেই বিজয়া দশমীর দিন দেবী বিসর্জনের মন্ত্র পাঠের ঠিক পরেই মণ্ডপের ঈশাণ কোণে অষ্টদল পদ্ম এঁকে অপরাজিতা লতা রেখে অপরাজিতা পুজো করা হয়। অপরাজিতা দুর্গার আর এক রূপ, তিনি চতুর্ভূজা। দেবীর হাতে শঙ্খ, চক্র, বর ও অভয়মুদ্রা। গায়ের রং নীল। ত্রিনয়না ও মাথায় চন্দ্রকলা।
আজও কিছু কিছু বনেদি বাড়িতে এই রীতি মানা হয়। বেশ কিছু বারোয়ারি পুজোতেও অপরাজিতা পুজো হয়।