মিষ্টি প্রিয় বাঙালি রসনায় ‘শুক্তো’ কেন প্রিয়?

বাঙালি মিষ্টি ভালোবাসে। ‘তেতো’ শুনলেই পাতের একধারে সরিয়ে রাখতে সময় নেয় না। বাজারে গিয়ে করলা, উচ্ছে, নিম এড়িয়ে যেতে চায় বিলক্ষণ। নেহাত বাড়ির চাপ, গিন্নির আদেশে যদিও বা ব্যাগে করে বাড়ি আসে কিন্তু মাছ-মাংস-মাটন-মিষ্টির ভিড়ে ‘তেতো’র দিকে আর তাকায় কে!

কিন্তু ‘তেতো’র দিকেও নজর পড়ে। সেই তেতোর স্বাদে উঠে যায় এক থালা ভাতও। মাছ-মাংস কিচ্ছু লাগে না ‘তেতো’র নাম যদি হয় শুক্তো, তবে চেটেপুটে থালা সাফ! শুক্তো ঝালও নয়, ঝোল নয়, চচ্চড়িও নয়। কেউ যদি বলে শুক্তো কি শুধু তেতো? অন্যজন সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠবে শুক্তো বাপু একটু মিষ্টি-মিষ্টি হলে চলে না!

কোনটাই ভুল নয়। শুক্তো আসলে বাঙালি হেঁশেলের আশ্চর্য অবাক এক পদ। যে পদে তেতো আর মিষ্টি মিলে যায় স্বচ্ছন্দে।

বাঙালি হেঁশেলে তেতো শুক্তো শুধু পদের বৈচিত্র্য বাড়ায় না, বা নেহাত শুধুমাত্র স্বাদের জন্য তা রান্নাঘরে জায়গা করে নেয়নি তার ঔষধি গুণও আছে। আয়ুর্বেদিক শাস্ত্র মতে বিভিন্ন মরসুমে নিয়মিত শুক্তো খেলে অনেক রোগ থেকে বাঁচা যায়। স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে।

শুক্তো নানা ধরনের হয়। রান্নার পদ্ধতিও এক এক হেঁশেলে এক একরকম। শুধু উচ্ছে, করোলার মতো তেতো সবজি নয়, পাতা বা শাক দিয়েও শুক্তো রান্নার চল আছে। নিম, হেলেঞ্চা, থানকুনি, গিমে, পলতা এমনকি সজনে গাছের ফুল দিয়েও রাঁধা হয়। সঙ্গে থাকে বিভিন্ন রকম মরসুমি সবজি। মূলত কম তেলে সিদ্ধ করে রান্না যে কারণে সবজির পুষ্টিগুণ পুরো মাত্রায় বজায় থাকে।   

ভাতের পাতে পঞ্চ ব্যঞ্জনের একেবারে শুরুর দিকের পদ শুক্তো। এখানেও আছে ঘটি-বাঙাল লড়াই। এপার বাংলা মানে ঘটি বাড়ির শুক্তো হয় পুরোদস্তুর নিরামিষ। একটু মিষ্টি মিষ্টি তেতো স্বাদ আর ঘিয়ের মিঠে গন্ধ তার প্রধান বৈশিষ্ট্য। অন্যদিকে পদ্মাপারের বাঙাল বাড়ির হেঁশেলে নিরামিষ তো বটেই মাছ দিয়ে আমিষ শুক্তো রান্নার চল আছে। সেও পদও ভাত দিয়ে শুরুতেই খেতে হয়। তবে ওপার বাংলায় নিম গাছের সহজলভ্যতার কারনে নিম পাতা দিয়ে শুক্তো বেশি জনপ্রিয়। অনেকে বলেন শুক্তো রান্নার চল হয়েছিল ওপার বাংলাতেই। কিন্তু সেই মতকে খন্ডন করে অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন শুক্তো রান্নার চল তারও বহু আগের। কারণ মঙ্গলকাব্যে শুক্তোর উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে। মধ্যযুগে চৈতন্যদেবের কৃষ্ণপ্রেমের ধারায় ভক্তিবাদী আন্দোলনের ধারায় যখন বাংলা থেকে নীলাচল উদ্বেল, তখন মহাপ্রভুর কৃষ্ণকে নিবেদন করা প্রসাদের ব্যঞ্জনে নিরামিষ শুক্তো থাকত।

তবে শুক্তো কিন্তু একচেটিয়া বাঙালিদের নয়। মহারাষ্ট্রে করলায়াচি ভাজি, কেরালার পাভাক্কা কারি, পারসি পদ ভাজি দানার সঙ্গে বাঙালি শুক্তোর বেশ মিল আছে।

বাঙালির ‘ক্ল্যাসিক’ শুক্তো তেতো আর নানারকম স্বজির সঙ্গে থাকে দুধ আর ঘি। দুধ দিয়েই রান্না হয় পুরো পদ। দুধ উচ্ছে বা করোলার তেতো ভাবকে অনেকটাই কমিয়ে আনে।

শুক্তোর শুরুয়াত নিয়ে একাধিক মত থাকলেও তার স্বাদ আর গুণ নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই। শুক্তো রান্না সহজ হয়েও ঠিক সহজ নয়। রাজকীয় শুক্তোর উপাচারো বেশ রাজকীয়। কিন্তু সহজ উপায়ও আছে। গিমে শাক দিয়ে শুক্তো কখনও খেয়েছেন, যদি না খেয়ে থাকেন তাহলে পরের বার গ্রামের দিকে বেড়াতে গেলে অবশ্যি একবার চেষ্টা করে দেখবেন মাটির হাঁড়িতে রান্না করা গিমে শুক্তো চেখে দেখার। নিজের বাড়িতেও একবার করে দেখতে পারেন। রেসিপি রইল।

 

গিমে শুক্তো

কী কী লাগবে

গিমে বা গিমা শাক

রাঙা আলু

বেগুন

ডাঁটা

মটর বা মুসুর ডালের বড়ি

শুকনো লঙ্কা

তেজপাতা

আদা আর রাধুনি একসঙ্গে বাটা

পাঁচফোড়ন

সরষের তেল

নুন আর চিনি

 

কীভাবে রান্না করবেন?

শাক ভালো করে ধুয়ে বেছে নেবেন। ছোট করে কেটে নেবেন। শাকের ডাল যদি শক্ত হয় তাহলে সেই অংশ কেটে বাদ দেওয়াই ভাল। বেগন, রাঙালু, সজনে ডাঁটা কেটে নেবেন। কড়াইতে সরষের তেল গরম হলে বড়ি ভেজে তুলে নিন। তারপর সেই তেলে তেজপাতা আর শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে শাক আর সবজি ভেজে নিন। জল বেরিয়ে এলে আদা-রাঁধুনি বাটা দিয়ে নাড়াচাড়া করে সামান্য জল দিয়ে ঢাকা দিন। একটু পরে বড়ি ছড়িয়ে দিন। সব সবজি এবং শাক ও বড়ি নরম হয়ে এলে নুন চিনি আর সামান্য ঘি দিয়ে নামিয়ে নিন। এই পদ চচ্চড়ির মতো শুকনো হবে না বেশ মাখামাখা হবে।     

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...