অম্বুবাচীর লোকাচার

  এখন তুমি কও আমারে একটু ছোট্ট করে

  ঘর ছেড়ে আর কোথায় থাকো বৃষ্টি যখন পড়ে  

  সারাবছর যেমন তেমন হলে আমাবতি

  ঘরে বাইরে কোন জায়গা হয়না আমার গতি

  মেঘকন্যা সাত বোন সাত রঙে সেজে 

  আমাবতি শুরু করে গুড়ুম গুড়ুম বেজে

 

মেঘের সশব্দ সহযোগে প্রবল বৃষ্টি নিয়ে আমাবতি বা অম্বুবাচী শুরু হয়। সংস্কৃত শব্দ ‘অম্বু’ অর্থ জল ও ‘বাচি’ শব্দের অর্থ আরম্ভ বা বৃদ্ধি। গ্রীষ্মের দাবদাহ শেষে আষাঢ়ের সমাগমে বর্ষা শুরু হয় তার ফলে মাটি  হয়ে ওঠে চাষ যোগ্য, হলকর্ষণ ও বীজ বপনের মধ্যে দিয়ে পৃথিবী শস্য-শ্যামলা হয়ে উঠে। ধরিত্রী মাতার এই শস্য সম্ভবা হয়ে ওঠার উপাচার নিয়ে অম্বুবাচীর আগমন। 

 মনে করা হয় আষাঢ়ের সাত থেকে দশ তারিখ মা ধরিত্রীর ঋতুমতী হওয়ার সময়। আষাঢ়ের ১১ তারিখ অর্থাৎ  চতুর্থ দিনে স্নান। লৌকিক মতে সেদিন বৃষ্টি ধারায় মা বসুমতি শুদ্ধ ও উর্বরা হয়ে উঠেন। সেই পুরা কাল থেকেই মাটিকে মাতৃবন্দনায় আরাধনা করা হয়। উৎপাদনশীলতার চক্রে নারী ও পৃথিবী খুব আশ্চর্য ভাবে পরস্পর সম্পর্কিত। ঋতুমতী হলে নারী যেমন সন্তানসম্ভবা হয় ঠিক পৃথিবীও হয়ে উঠে শস্য সম্ভবা। ঋতুকালে যেমন সহবাস চলে না সেই ধারণা থেকে অম্বুবাচীর সময় চাষিরা লাঙ্গল কর্ষণ করে না, কারণ লাঙ্গল শব্দটি এসেছে লিঙ্গ থেকে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী আষাঢ় মাসে মৃগশিরা নক্ষত্রের তিনটি পদ শেষ হলে ধরিত্রী ঋতুমতী হয়। এসময় তিন দিন কোন মঙ্গল কার্য চলে না। অনেক জায়গায় মন্দিরের প্রবেশ দ্বার বন্ধ থাকে। আসামের কামাখ্যা মন্দিরে অম্বুবাচী ধুমধামের সঙ্গে পালন হয়। পৌরাণিক মত অনুযায়ী সতীর দেহাংশের অংশবিশেষ যোনি এখানে পড়েছিল। শক্তির আর এক রূপ দেবী কামাক্ষ্যা রজঃস্বলা হন অম্বুবাচীতে। চার দিন বন্ধ থাকে মন্দির।

ambubachi-mela-1587645445 (1) (1)

চার দিন ধরে চলে অম্বুবাচীর মেলা। কথিত আছে, এই সময়ে তন্ত্রচর্চা করলে শ্রেষ্ঠ ফল মেলে। তান্ত্রিক, অঘোরীদের ভিড় জমে কামাক্ষ্যায়। মাতা পৃথ্বী আর দেবী সতী বিশ্বাসের পরাকাষ্ঠায় চেপে একাকার হয়ে যান। উড়িষ্যাতে এই উৎসবকে রজ উৎসব নামেই পালন করা হয়। চতুর্থ দিন অর্থাৎ অম্বুবাচী নিবৃত্তির দিন কামাখ্যা মন্দিরের পান্ডারা রক্তের নিশান হিসাবে রক্তবস্ত্র উপহার দেন। এই বস্ত্র পুরুষের ডান হাত বা গলায় ও মহিলারা  বাম হাত বা গলায় পরিধান করলে নাকি মনোস্কাম পূর্ণ হয়। বহুকাল ধরে চলে আসা এরকম মিথের উপর দাঁড়িয়ে মানুষ তার আজীবন ধরে লালিত বিশ্বাসের ওপর ভর করে এইসব উৎসব নিষ্ঠা সহকারে পালন করে। আসাম উড়িষ্যা ছাড়াও বাংলায় অম্বুবাচী উৎসবের প্রচলন দেখা যায়। বিশেষ করে দক্ষিণ বঙ্গের দিকে ঠাকুরের থানে (যেখানে দেবদেবী প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন) পুজো করা হয়। বাড়ি বাড়িও এই পুজো হয়ে থাকে গ্রাম দেবতার স্থলে, এগুলো বেশিরভাগই গ্রামের প্রান্তে কোন গাছ তলায় অবস্থিত। পুরুলিয়া বাঁকুড়ার দিকে এগুলিকে গ্রাম থান বা গেরাম খান বলে। এখানে শিলাখণ্ডের সাথে সাথে মাটির হাতি ঘোড়া দের দেবীরূপে পুজো করা হয়। সিন্দুর চর্চিত হয়ে আতপ চাল, দুধ, দূর্বাঘাস সহযোগে পূজা হয়। মা ধরিত্রীর কষ্টের কথা ভেবে তার শরীরের উপর আগুন জ্বালানো চলে না। সেই প্রাচীন নিয়ম মেনে রান্না করা খাবার এই দিন বাড়িতে চলে না। লাঙ্গলের ফলা বা ওই জাতীয় ধাতব জিনিসপত্র মাটি থেকে উপরে তুলে রাখা হয়। মূলত ওই দিনটি ফলাহার করা হয় ও তারপরেই মানুষ এক নতুন উদ্যোমে চাষের কাজে নেমে পড়ার এক মানসিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। 

 গাঁয়ের লোকে এ কয়দিন জোয়াল লাঙ্গল কাঁচি

 ধুয়ে মুছে দেখে শুধু মেঘের নাচানাচি 

 আমাবতি শুরু থেকে সূর্য মামার ঘুম

 মেঘ কন্যা বিদায় নিলে শুরু কাজের ধুম।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...