'লিঙ্গ পুরাণ' বলছেন, সৃষ্টির আদিতে যখন কিছুই ছিল না, তখন একমাত্র শিব ছিলেন। তিনিই আদি, তিনিই ওঙ্কার, তিনিই ব্রহ্ম। তাঁরই সৃষ্ট অণ্ড থেকে নির্মিত হয়েছিল ব্রহ্মাণ্ড। তিনিই ছিলেন এই সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডে এবং ব্রহ্মাণ্ডের বাইরের অনন্তে বিস্তৃত। তাঁর কোন আকার ছিল না। নিরাকার হয়ে বিরাট শক্তির আধার হয়েও নিজেকে একদা বড় একা মনে হল তাঁর! সেই একাকীত্ব যখন তাঁকে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে লাগল, তখন অনন্তে ও ব্রহ্মাণ্ডে সৃষ্টির প্রয়োজন অনুভব করলেন তিনি। সৃজন করলেন তিন আদি দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরকে। ব্রহ্মাকে দিলেন সৃষ্টির ভার, বিষ্ণুকে দিলেন পালনের ভার আর মহেশ্বরকে দিলেন সংহারের ভার।
ভার পেয়ে তিন দেবতা ভারি আহ্লাদিত হলেন। ব্রহ্মা সৃষ্টি করলেন দেব-মানব-দানব। বিষ্ণুর হাতে তারা প্রতিপালিত হল। সৃষ্টির যুগপর্ব হল, 'কল্প'। এক কল্প শেষ হতেই মহেশ্বরের হাতে সমস্ত সৃষ্টি লয় পেল। তখন ঘোর অন্ধকারে চারিদিক ভরে গেল। জগৎ জলময় হল। জগৎ মোহময় হল। পিতামহ ব্রহ্মা সেই মোহের বশীভূত হলেন। বিগত কথা বিস্মৃত হলেন। অহং ছাড়া আর তাঁর কিছুই অবশিষ্ট রইল না। তিনি শুধু দেখতে পেলেন এক দিব্যপুরুষ জগতব্যাপ্ত জলে অত্যন্ত প্রশান্তির সঙ্গে যোগনিদ্রায় সুপ্ত। দেখে তাঁর খুব রাগ হল। তিনি তক্ষুনি সেই নিদ্রিতের কাছে গেলেন এবং কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওহে নিদ্রিত, তুমি কে?’
সেই দিব্যপুরুষ কোন উত্তর দিলেন না, নিদ্রা ছেড়ে উঠলেনও না। তখন ব্রহ্মা আরও রেগে গিয়ে তাঁকে বলপ্রয়োগ করে সলিলশয্যা থেকে টানতে টানতে তুলে বসিয়ে দিলেন। তখন দিব্যপুরুষ মৃদু মৃদু হেসে তাঁকে মধুর স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওহে বৎস, তোমার কোন কষ্ট হয়নি তো?’
দিব্যপুরুষ-এর মুখে ‘বৎস’ সম্বোধন শুনে ব্রহ্মার অহংকারে আঘাত লাগল। তিনি আরও রেগে গেলেন। অত্যন্ত রূঢ়ভাবে বললেন, ‘ওহে তোমার স্পর্ধা তো কম নয়! তুমি নিজেকে গুরুর আসনে বসিয়ে আমাকে ‘বৎস’ সম্বোধন করছ! জানো না, আমি কে? আমি জগতের স্রষ্টা, জগতের বিধাতা, বিষ্ণু-মহেশ্বরের স্রষ্টা, আমিই সৃষ্টিসংহারের কারণ!’
ব্রহ্মার কথা শুনে তেমনি মধুর হেসে দিব্যপুরুষ বললেন, ‘ওহে ব্রহ্মা, তুমি মোহের বশে আমাকে চিনতে পারছ না। তাই তোমায় তোমার কথায় আমি কিছু মনে করছি না। আমি বিষ্ণু। জেনে রাখো, আমিই জগতের কারণ, আমিই জগতের স্রষ্টা। ব্রহ্মাণ্ডে আমার তুল্য কেউ নেই।’ অনন্তবিহারী পরমেশ্বর বুঝলেন, মোহ বিষ্ণুকেও ছাড়েনি!
ওদিকে বিষ্ণুর কথা শুনে ব্রহ্মা তাচ্ছিল্যে হেসে উঠলেন। এবার রাগ হল বিষ্ণুর। শুরু হল দুজনের বাগবিতণ্ডা। সেই বাগযুদ্ধ অবিলম্বেই প্রলয়কারী যুদ্ধে পরিবর্তিত হল। সহস্র বছরেও যখন সেই যুদ্ধ শেষ হল না, তখন তাঁদের দুজনের মাঝখানে হঠাৎ এক অনন্ত জ্যোতির্ময় লিঙ্গের আবির্ভাব ঘটল। সেই লিঙ্গ দর্শনে বিষ্ণু আশ্চর্য হলেন ও মোহিত হলেন। বুঝতে পারলেন না, এই লিঙ্গ ঊর্ধ্ব না নিম্ন, কোথা থেকে আবির্ভূত হল! তখন যুদ্ধ থামিয়ে তিনি ব্রহ্মাকে বললেন, ‘প্রথমে এই লিঙ্গের উৎসস্থান নির্ণয় করা দরকার। তুমি ঊর্ধ্বে অনুসন্ধান কর, আমি নিম্নে গমন করছি।’ এই বলে তিনি প্রকাণ্ড বরাহরূপ ধারণ করে নিম্নে গমন করলেন, ব্রহ্মাও বিরাট এক হংসের রূপ ধারণ করে ঊর্ধ্বে উড়ে গেলেন।
ব্রহ্মা ও বিষ্ণু দুজনেই সহস্র বৎসর ধরে অনুসন্ধান করে ক্লান্ত হয়ে গেলেন। কিন্তু, সেই লিঙ্গের উৎস খুঁজে পেলেন না। তখন দুজনেই ফিরে এসে পূর্বের স্থানে মিলিত হলেন এবং ভয়ে কম্পিত হয়ে করজোড়ে সেই জ্যোতির্ময় লিঙ্গের উদ্দেশ্যে প্রণাম জানালেন। তাঁরা সেই লিঙ্গের সম্মুখে নত হতেই, সেখানে ভেসে আসতে লাগল মোহবিদারি আদি নাদ ‘ওঙ্কার’। সেই নাদ ক্রমে জগতময় ব্যাপৃত হল। তখন দুজনের মোহের আবরণ দূর হল। দুজনেই অন্তরে-চৈতন্যে অনুভব করতে লাগলেন ব্রহ্মময় শিবকে। সেই আদি নাদ ‘ওঁ’ প্রকাশ করল নিরাকার শিবের স্বরূপ। ব্রহ্মা-বিষ্ণু দুজনেই বুঝতে পারলেন, একমাত্র ভগবান শিবই অনাদি, অবিনাশী, সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের কারণ। ‘অ’ অক্ষরে তিনিই সৃষ্টির বীজ, ‘উ’ অক্ষরে তিনিই যোনীস্বরূপ, ‘ম’ অক্ষরে তিনিই পুরুষ। তিনিই স্বেচ্ছায় ভিন্ন ভিন্নরূপে নিজেকে বিশ্লেষ করে সৃষ্টির কারণ হন। কাল পূর্ণ হলে তিনিই তা লয় করেন। তাঁর স্বরূপ উপলব্ধি করে ব্রহ্মা ও বিষ্ণু তাঁকে স্তবে তুষ্ট করে সেই জ্যোতিস্বরূপ লিঙ্গে চিরকাল অধিষ্ঠান করার জন্য প্রার্থনা জানালেন। শিব সেই প্রার্থনায় তুষ্ট হলেন। পুনরায় ব্রহ্মাকে সৃষ্টি আর বিষ্ণুকে পালনের উপদেশ দিয়ে অধিষ্ঠিত হলেন সেই অনাদি লিঙ্গে। ভগবান শিবের নিরাকার ব্রহ্মরূপের প্রতীক হল এই লিঙ্গ। এখানে ‘লিঙ্গ’ শব্দের অর্থ, ‘লয়কারী’। সেই ‘লয়কারী’ শিবকে আরাধনায় তুষ্ট করতে এভাবে ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর হাত দিয়েই শুরু হয়েছিল ‘লিঙ্গ’ পূজার।