টোকিও অলিম্পিক্সের উদ্বোধনের দিন দেশের পতাকা থাকার কথা ছিল তাঁরই হাতে। কিন্তু টোকিওতে পা রেখেই চলে যেতে হয় কোয়ারেন্টাইনে। আলো ঝলমলে অনুষ্ঠানের সন্ধে থেকে অনেকটা দূরে নিভৃতাবাসের ছটফটানিতে কেটেছিল দিন। কী হতে চলেছে আগামী দিনগুলো সেই টেনশনও কিছু কম ছিল না। তবে সেই রাউন্ডে শেষ পর্যন্ত জিতে গিয়েছিল মনের জোর। যার জোরেই টোকিও প্যারালিম্পিক্সের মঞ্চে হাইজাম্পে রুপো জিতলেন তিনি। মারিয়াপ্পান তাঙ্গাভেলু।
রিও অলিম্পিক্সে হাইজাম্পে সোনা এনেছিলেন দেশের জন্য। তার পর থেকেই খবরের শিরোনামে। পদ্মশ্রী পেয়েছেন। পেয়েছেন মেজর ধ্যানচাঁদ খেলরত্ন সম্মানও।
১৯৯৫-এর ২৮ জুন তামিলনাড়ুর পেরিয়াভেদা গণপত্তি জেলায় জন্ম। ছয় ভাইবোন। ছোটবেলায় বাবা তাঁদের পরিত্যাগ করেন। ছয় সন্তান নিয়ে চূড়ান্ত অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়েন মা সরোজা। সহায় সম্বলহীন পরিস্থিতি। প্রচন্ড দারিদ্র। বাধ্য হয়ে নির্মাণ কর্মীর কাজ নেন। মাথায় করে ইট পৌঁছতে হত।
কিছুদিন পর সব্জির ব্যবসা শুরু করেন। প্রতিদিনের আয় একশো টাকা। নিদারুণ পরিশ্রম, আর অসম্ভব যত্নে ছেলেমেয়েদের বড় করছিলেন সরোজা।
ছেলে মারিয়াপ্পান যখন পাঁচ বছর বয়স তখন আচমকাই বদলে গেল সব। একদিন একা একা স্কুল যাচ্ছিলেন। বেজায় তাড়া। এমন সময় ঝাঁপিয়ে পড়ল একটা ট্র্যাক। পিষে দিয়ে গিয়েছিল ডান পাটা। জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছিল সকলে। কিন্তু ছোট্ট মারিয়াপ্পান লড়াই করেছিলেন খুব। ছেলেকে সুস্থ করতে ৩ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন মা।
হাইস্কুলটা কেটে গিয়েছিল নিজের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে নিতে। মারিয়াপ্পনের কথায়, “আমি কিছুতেই বাকিদের থেকে ‘আলাদা’ ভাবতে পারতাম না নিজেকে।”
শুরুর দিকে মারিয়াপ্পান ভলিবল খেলতেন। পরে স্কুলের খেলাধূলার মাস্টারমশাই তাঁকে ‘হাইজাম্প’ চেষ্টা করে দেখার পরামর্শ দেন। চোদ্দো বছর বয়সে প্রথম প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেন। সেখানে বিশেষভাবে সক্ষম প্রতিযোগী একমাত্র তিনি। বাকিরা সবাই সাধারণ। রুদ্ধশ্বাস প্রতিযোগিতায় মারিয়াপ্পানের লড়ে যাওয়া দেখে অবাক হয়েছিল বন্ধু, সহপাঠীরা। তাদের ধারণা বদলে যায় তার প্রতি।
২০১৩-তে ন্যাশনাল প্যারা-অ্যাথলিট চ্যাম্পিয়নশিপের আসরে কোচ সত্যনারায়ণার চোখে পড়ে যান। তিনি তখন স্পোর্টস অ্যাকাডেমি অফ ইন্ডিয়া ডিফারেন্টলি এবেলড-এর দায়িত্বে। দু’বছর পর বেঙ্গালুরুতে তাঁর ক্যাম্পে ছাত্র হিসেব যোগ দেন।
সেই অভিজ্ঞতা পুরোপুরি বদলে দেয় তাকে। কড়া অনুশাসনে নিজেকে প্রস্তুত করে তোলেন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার জন্য। সদর্থক ফল মেলে পরের বছরই। ২০১৬-র নভেম্বরে। টিউনিশিয়ার আইপিসি গ্র পি-তে। রিও প্যারালিম্পিক্সের জন্য নির্বাচিত হন।
সোনা জিতে আসেন সেখান থেকে। ২০১৯-এ দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড প্যারা-অ্যাথলিটক্স চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ পেয়েছিলেন।পুরস্কারের টাকা থেকে মাকে ধান জমি কিনে দিয়েছিলেন মারিয়াপ্পান। মাথার ওপর ছাদের ব্যবস্থা করেছিলেন পরিবারের জন্য।
ক্রীড়াবিদের সাফল্য আর খ্যাতি দুই বদলে দিয়েছে মারিয়াপ্পানের জীবনকে। বদলে গিয়েছে চারপাশটাও। তবে বন্ধুরা যখন তাঁকে তারকাসুলভ দৃষ্টিতে দেখে তখন একটু অস্বস্তিতে পড়ে যান। মারিয়াপ্পান একই আছেন, একই থাকতে চান পৃথিবী জোড়া সাফল্য পাওয়ার পরেও মাটি ছোঁয়া মানুষ...