শাস্ত্রে বলা হয়েছে মাতা বিমলা শ্রী জগন্নাথের তান্ত্রিকা পত্নী। তিনি জগন্নাথধামের রক্ষায়ত্রী। তাঁকে দর্শন না করলে জগন্নাথ ধাম দর্শন সম্পূর্ণ হয় না। দেবী বিমলা শ্রীক্ষেত্রের শক্তির উৎস। তাঁর শরণে এলে মানুষ ব্রহ্মগামী হয়। তিনিই মহামায়া। তিনিই আদ্যাশক্তি।
মা বিমলার নানা রূপ। তিনিই শ্রীদুর্গা, ভুবনেশ্বরী, তারা, চণ্ডিকা, কাত্যায়নী।
শ্রীক্ষেত্রে বিমলা মন্দির তৈরী হয় খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দীতে। জগন্নাথ দেবের বর্তমান মন্দির তৈরী হয় দ্বাদশ শতাব্দীতে।
নাটমন্দির দ্বারা সুসজ্জিত। দশমহাবিদ্যার চিত্র খোদাই করা মন্দির গাত্রে। মন্দিরে প্রবেশ করার সময় চোখে পড়বে বিমলা মায়ের বাহন সিংহকে। অদ্ভুত আশ্চর্য সেই মূর্তি। বাহন সিংহ হাতির ওপর দন্ডায়মান। এই সিংহের সৃষ্টি ও নির্মাণ নিয়ে একটি লোককাহিনি প্রচলিত আছে।
শোনা ওড়িশার কোনও এক শিল্পী রাজ আদেশে দেবীর সিংহ নির্মাণ করতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেই সিংহ রাজার পছন্দ হয়নি। অনেক চেষ্টা করেও রাজাকে সন্তুষ্ট করতে পারলেন না। একদিন তাঁর শিশুকন্যা মেঝেতে চকখড়ি দিয়ে খেলাচ্ছলে নিজের কল্পনায় ঘণ্টা-মুকুট-হার-আলপনা শোভিত এক সিংহ এঁকেছিল। সেই আঁকাকেই পাথরের গায়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন শিল্পী। স্থানীয় বিশ্বাস, মা বিমলাই তাঁর কন্যার রূপ ধরে শিল্পীর কাছে এসে তাঁর প্রিয় বাহনের রূপ এঁকে দিয়ে গিয়েছিলেন।
মন্দিরের ভোগ মণ্ডপের কুলুঙ্গিতে থাকেন গণেশ আর কার্তিক। গর্ভগৃহে থাকেন দেবী বিমলা। তিনি চতুর্ভূজা। একহাতে অমৃতের কলস। অন্য হাতে অক্ষমালা। আর হাতে অভয়মুদ্রা আর নীচের হাতটিতে নাগকন্যা।
অক্ষমালায় পঞ্চাশটি বর্ণমালাকে ধারণ করে আছেন তিনি। অভয়মুদ্রায় জীবকুলকে অভয় দান করেন। তাঁর হাতের নাগকন্যা যোগের প্রতীক। কুলকুণ্ডলিনীর জাগরণ আর সাধকের সিদ্ধি তাঁর হাতেই। তিনিই দেন অমৃতের সন্ধান। সেই অমৃত জ্ঞান আর ভক্তির অমৃত। দেবী বিমলা সর্বসিদ্ধিদায়িনী।
বিমলা মায়ের দুই পাশে দুই সঙ্গিনী জয়া আর বিজয়া। গর্ভ গৃহে আছে আরও দুটি কুলুঙ্গি। সেখানে অবস্থান করেন অষ্টভুজা দুর্গা আর ষড়ভুজা চামুণ্ডা।
বিমলা দেবীর পুজো হয় তন্ত্র মতে, পঞ্চমাকারে। পঞ্চমাকার উপাসনার অঙ্গ মৎস, মাংস, মদ্য, মুদ্রা এবং মৈথুন। দেবীর পূজার উপাচারে এই পাঁচের বিকল্প ব্যবহার করা। মৎসের বিকল্প হিং দিয়ে রান্না করা শাক। মাংসের বিকল্প আদা। মদ্যের বিকল্প কাঁসার পাত্রে ডাবের জল, মুদ্রার বিকল্প গোলা চিনি ও মইয়দা, মৈথুনের বিকল্প রক্ত চন্দনচর্চিত অপরাজিতা ফুল এবং শ্বেত চন্দনচর্চিত কলকে।
প্রতিদিন জগন্নাথের আরাধনের পরেই দেবীর পুজো হয়। দুর্গাপুজোর সময় হয় প্রধান উৎসব। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা নবমী থেকে শুক্লা নবমী পর্যন্ত টানা ১৬ দিন ধরে উৎসব চলে। এই সময় আট দিনের জন্য তাঁর কাছে আসেন দূর্গামাধব। তিনি জগন্নাথের প্রতিনিধি। দেবীর সঙ্গেই এক বেদীতে পূজিত হন। নানা বেশে দেবী বিমলার পুজো হয়। তিনি নারায়াণী, সিংহবাহিনী, জয়দুর্গা, শূলী দূর্গা, বগলা, মাতঙ্গিনী, হরচন্ডীর মতো দ্বাদশ বেশে সাজেন। এই সময় মৎস এবং মাংসের আমিষ ভোগ দেওয়া হয় দেবীকে। মেষ বলি হয়। তবে ভূমি স্পর্শ না করে, সবটা অনুষ্ঠিত হয়। জগন্নাথ মন্দির খোলার আগেই রাতের মধ্যে শেষ হয় এই পর্ব।
দশমী তিথিতে পুরীর রাজা স্বয়ং বিমলা মাকে মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার রূপে আরাধনা করেন। যদিও মায়ের পুজো, তবু এই পুজোয় মহিলাদের প্রবেশাধিকার নেই। মায়ের উগ্রচন্ডারূপ তাঁরা সহ্য করতে পারবেন না তাই এই ব্যবস্থার চল।
জগন্নাথের মহাপ্রসাদ তাঁর দেবী বিমলার জন্যই হয়ে ওঠে ‘মহাপ্রসাদ’। প্রতিদিন জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলরামকে ভোগ নিবেদনের পর ভোগের প্রধান পাত্র প্রতিদিন দেবী বিমলার মন্দিরে আনা হয়। তাঁকে নিবেদন করার পর সেই পাত্র শ্রী মন্দিরের গর্ভগৃহে ফিরিয়ে আনা হয়। সেই ভোগ অন্যান্য পাত্রে মিশিয়ে দিলে তবেই হয় তা মহাপ্রসাদ।
তন্ত্রচূড়ামণি শাস্ত্র অনুসারে এই স্থানে সতীর খাদ্যের অবশিষ্ট অংশ পড়েছিল, তাই এই রীতি। মহাপ্রসাদ ঘিরে নানা অত্যাশ্চর্য কাহিনি শোনা যায়।