শ্রীমতি রাধারানী হলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। হ্লাদেনী শব্দের অর্থ আনন্দদায়িনী অর্থাৎ রাধারানী তিনিই যিনি ভগবানকে আনন্দ দান করেন! ভাবুন ভগবান স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ এই সৃষ্টিতে লীলা করে সৃষ্টির প্রতিটি অণু-পরমাণুতে আনন্দ সঞ্চার করেন আর ভগবানকে আনন্দ দান করেন যিনি, তিনি রাধা অর্থাৎ রাধার মাহাত্ম্য ঠিক কত! বৈষ্ণব শাস্ত্রে বলা হয়, ভগবান কৃষ্ণ তত্ত্ব অপেক্ষাও রাধারানীর তত্ত্ব কঠিন। স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজের চাইতে রাধারানীকে আগে স্থান দিয়েছিলেন, প্রেম ভক্তির পরাকাষ্ঠা স্বরূপ রাধারানীকে তিনি নিজের গুরু বলে মেনে ছিলেন। তাই বৈষ্ণব শাস্ত্রে বলেছে, রাধারানীর শরণ নিলে তবেই শ্রী কৃষ্ণের কৃপা পাওয়া যায়।
ভগবান হলেন সর্বশক্তিমান আর রাধারানী হলেন ভগবানের সেই শক্তি। আমাদের সনাতন শাস্ত্রে বলা হয় রাধারানী এবং শ্রীকৃষ্ণ দুজনে অভিন্ন, তারা শুধু লীলা করবার জন্য ভিন্ন হয়েছিলেন। হ্যাঁ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে আনন্দ প্রদানের জন্য শরীরের বাম অংশ থেকে শ্রীমতি রাধারানীকে সৃষ্টি করেছিলেন! রাধারানী আসলে লক্ষীদেবীর অংশ আর শ্রীমতি রাধারাণীর থেকেই সমস্ত গোপীদের সৃষ্টি।
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণও সর্বাকর্ষক অর্থাৎ তিনি প্রাণীকুল, মনুষ্যকুল, ত্রিভুবনের সমস্ত কীটপতঙ্গ থেকে শুরু করে দেবকুলকে পর্যন্ত আকৃষ্ট করেন আর এই সর্বশক্তিমান সর্বাকর্ষক শ্রীকৃষ্ণকেও আকর্ষিত করেন যিনি, তিনি রাধারানী। শ্রীকৃষ্ণ কামদেবকে আকর্ষণ করেন তাই তার নাম মদনমোহন (যেহেতু কাম দেবের অপর নাম মদন) আর শ্রীরাধা রাণী শ্রীকৃষ্ণকে আকর্ষণ করেন তাই তার নাম মদনমোহনমোহিনী।
শ্রীমতি রাধারানী ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন এই তিথিকেই বলা হয় রাধাষ্টমী। ২০২১ সালে ২৮ শে ভাদ্র অর্থাৎ ১৪ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার শুভ রাধাষ্টমী তিথি। রাধাষ্টমী তিথিতে যদি কেউ শ্রী রাধারানীর সম্পর্কিত কথা শ্রবণ করেন, তাহলে তার কেবল অশেষ পূণ্য ফল লাভ হয় তাই নয় সে শ্রী কৃষ্ণের কৃপা ও প্রাপ্ত হয়। কিন্তু রাধারানী সম্পর্কিত সঠিক তথ্য পাওয়া খুব কঠিন, কারণ আগেই বলেছি রাধাতত্ত্ব উপলব্ধি করতে সবাই পারেন না। তাই আজ সহজভাবে আমি রাধারাণীর সম্পর্কিত দুচার কথা বলবো, এর মধ্য দিয়ে রাধারাণীর পরিচয় ও রাধাষ্টমী ব্রতের মাহাত্ম্য আপনারা বুঝতে পারবেন।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ ও দেবীভাগবতে রাধারানীর সম্পর্কে বলা হয়েছে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরীরের বাম ভাগ থেকে সৃষ্টি হয়েছিলেন রাধারানী এবং সেই রাধারানীই দ্বাপর যুগে বৃষভানুর কন্যা রূপে আবির্ভূতা হয়েছিলেন মর্ত্যে। শ্রীকৃষ্ণ ও রাধারানীর মধ্যে গুপ্ত বিবাহ হয়েছিল। স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মা ভান্ডির বনে রাধারাণীর সাথে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বৈদিক শাস্ত্র রীতিতে ব্রহ্ম বিবাহ দিয়েছিলেন।
ঋক বেদ ও রাধিকা উপনিষদে বলা হয়েছে, দেবী রাধিকা হলেন শ্রীকৃষ্ণের সর্বপ্রিয়া আরাধিকা, স্ত্রী,প্রেমিকা ও সখী। পরবর্তীতে শ্রীরাধার সাথে বৃন্দাবনের আয়ান ঘোষের বিবাহ হয়েছিলো। এই বিবাহের কারণ হিসেবে বলতে হয় শ্রীকৃষ্ণ ও রাধা রানীর লীলা। শ্রী রাধারানী হলেন ভক্ত শ্রেষ্ঠ আর শ্রীকৃষ্ণ হলেন ভগবান, রাধা কৃষ্ণের মিলন তাই ভক্ত আর ভগবানের মিলন। এই মিলন দৈহিক কামনা বাসনার মিলন নয়, এই মিলন আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলন।
ভগবানকে লাভ করতে গেলে ভক্তকে যে ঘর, সংসার সবকিছু ভুলে ভগবানের দিকে ছুটতে হয়, সমস্ত কাজের মধ্যেও তাকে কৃষ্ণময় হয়ে উঠতে হয় এই শিক্ষাই দিয়েছিলেন রাধারানী। শাস্ত্রে বলা হয়, ভক্তের চরণ ধরলে তবেই ভগবানকে পাওয়া যায়, তাই রাধারানীর চরণ ধরলে তবেই শ্রীকৃষ্ণ মেলে।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পাশে রাধারানীকেই দেখা যায়, রাধারানীকে ছাড়া শ্রীকৃষ্ণ সম্পূর্ণ নন - অর্থাৎ ভক্ত ছাড়া ভগবান অসম্পূর্ণ, ভক্তের ভক্তিতেই ভগবান - এই চিরাচরিত সত্যের প্রকাশ ঘটেছে রাধা কৃষ্ণের বিগ্রহে।
রাধাষ্টমী ব্রত মাহাত্ম্য
১। কেউ রাধাষ্টমী ব্রত পালন করলে তার কোটি ব্রহ্মহত্যার পাপ চলে যায়।
২। রাধাষ্টমী ব্রত একবার পালন করলে সহস্র একাদশী পালনের একশো গুণ ফল লাভ হয়।
৩। পর্বত সমান সোনা দান করলে যে ফল লাভ হয়, তার একশো গুণ ফল লাভ হয়, রাধাষ্টমী ব্রত পালনে।
৪। একবার রাধাষ্টমী ব্রত পালন করলে সহস্র কন্যাদানের ফল লাভ হয়।
৫। একবার রাধাষ্টমী ব্রত পালনে গঙ্গা আদি সকল তীর্থের ফল লাভ হয়।
৬। যদি কোন পাপী ব্যক্তি অশ্রদ্ধায় বা অবহেলাতেও রাধাষ্টমী ব্রত পালন করে তাহলে তার কোটি কুল সহ বিষ্ণুলোকে নিত্যকাল বিরাজ করে।
৭। একবার রাধাষ্টমী ব্রত পালন করলে গোহত্যা ব্রহ্মহত্যা সহ সকল পাপ বিনষ্ট হয়।
৮। যদি কোন মূঢ় ব্যক্তি জেনে বা না জেনে রাধাষ্টমী ব্রত পালন না করে তাহলে শতকোটি কল্পেও সে নরক যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পাবে না।
৯। যে নারী রাধাষ্টমী ব্রত পালন করে না, সে কোটিকল্পে নরকবাস করে থাকে আর পৃথিবীতে কোন ভাবে জন্মগ্রহণ করলেও তাকে বিধবা হতে হয়।
১০। যদি কেউ রাধাষ্টমী ব্রত মাহাত্ম্য শ্রবণ করে, তাহলে সে নিত্যকাল বৈকুণ্ঠলোকে বাস করার সৌভাগ্য অর্জন করতে পারে।
রাধাষ্টমীর ব্রত রেখে ভক্তরা রাধারাণীর কাছে প্রার্থনা করবেন,“ শ্রীরাধিকা কৃপা পূর্বক আমাকে তার শ্রীপাদপদ্মের দাস্য দান করুন।” আর আগেই বলেছি শ্রী রাধারানীর দাসত্ব গ্রহণ করার অর্থ হল শ্রীকৃষ্ণের কৃপা লাভ।