যদি প্রশ্ন হয়, দেবী দুর্গার মৃন্ময়মূর্তি অর্থাৎ মাটির মূর্তির প্রথম নির্মাতা ও পূজারি কে বা কারা; তাহলে আমরা সবাই একবাক্যে বলব, রাজা সুরথ ও বণিক সমাধির কথা! 'মার্কণ্ডেয় পুরাণ'-এ দেবী চণ্ডীর কাহিনি থেকে তাই-ই তো আমরা জেনেছি! 'চণ্ডীপাঠ'-এর আসরে কতবার সেই গল্প শুনেছি। অথচ, 'দেবী ভাগবত পুরাণ'-বলছেন, আমাদের সেই জানা ও শোনা নাকি অর্ধসত্য, পূর্ণসত্য কিছুতেই নয়! এই পুরাণ মতে, সুরথ ও সমাধির বহুযুগ আগেই নাকি দু'বার দেবীর মাটির মূর্তি নির্মাণ করে পুজো হয়ে গেছে! শুধু এটুকু বলেই 'দেবী ভাগবত পুরাণ'-ক্ষান্ত হননি। স্পষ্টই ঘোষণা করেছেন যে, সুরথ ও সমাধি দেবীর পুজো করেছেন সে-কথা ঠিক, কিন্তু তাঁরা কখনই মাটির মূর্তি নির্মাণ করেননি! এই সব মিলিয়েই তৈরি হয়েছে দুই পুরাণে গল্পপরম্পরার গরমিল। সেই গরমিল কাহিনিই আজ আমরা শুনব :
।। 'দেবী ভাগবত পুরাণ'-এর গল্প ।।
বিষ্ণু অনন্তশয্যায় শায়িত। তাঁর মনে স্রষ্টার স্রষ্টা হয়ে ওঠার বাসনা। বাসনা কুসুমিত হল। বিষ্ণুর নাভি থেকে বিকশিত হল পদ্ম। প্রস্ফুটিত পদ্মে জন্ম হল ব্রহ্মার। জন্মলগ্ন থেকেই ব্রহ্মা বয়োবৃদ্ধ। পক্ক কেশ, পক্ক দাড়ি নিয়ে তিনি হলেন জাগতিক অভিজ্ঞতার প্রতিভূ। নিলেন জীব সৃষ্টির ভার। মন থেকে প্রথম সৃষ্টি করলেন এক পুত্রসন্তানের। তাকে বলা হতে লাগল, 'মনু'। স্বয়ং ব্রহ্মা তাঁকে দিলেন আরও একটি পোশাকি নাম, তাঁকে ডাকলেন, 'স্বয়ম্ভুব' বলে। পুত্রসৃষ্টির পর ব্রহ্মা মন থেকে এক কন্যাসন্তানের জন্ম দিলেন। সেই কন্যার নাম দিলেন, 'শতরূপা'। জগতে সংসারজীবনের উন্মেষ ঘটাতে, বংশপরম্পরার সূচনা করতে ব্রহ্মা কন্যা শতরূপার বিয়ে দিলেন। বিয়ে দিলেন নিজেরই মানসপুত্র স্বয়ম্ভুবের সঙ্গে। নবদম্পতি যাতে সুখে-শান্তিতে সংসারজীবন যাপন করতে পারেন, সেই জন্য পিতা হিসেবে ব্রহ্মা তাঁদের দেবী ভগবতী দুর্গার মাটির মূর্তি গড়ে পুজো করতে উপদেশ দিলেন। পিতার উপদেশ মাথায় নিয়ে দেবীর কৃপা লাভ করতে স্বয়ম্ভুব ও শতরূপা গেলেন ক্ষীরোদ সাগরের তীরে। সাগর তীরের মাটি দিয়ে তাঁরা নির্মাণ করলেন দেবী দুর্গার মূর্তি। সেই মূর্তি পূজা করে তাঁরা লাভ করলেন দেবীর অনুগ্রহ। দেবীর অনুগ্রহেই সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরে উঠল তাঁদের সংসার। এই হল মাটির মূর্তিতে প্রথম দেবীপূজার গল্প।
কিছুকালের মধ্যেই স্বয়ম্ভুব ও শতরূপার একটি পুত্রসন্তান হল। তাঁর নাম দেওয়া হল, 'স্বারোবিষ'। দেবতারা সেই পুত্রকে 'দ্বিতীয় মনু'-র আসনে বসালেন। 'মনু' ততদিনে হয়ে উঠেছে, 'রাজা'-র মতোই একটি পদের নাম। সত্য-ত্রেতা-দ্বাপর-কলি--এই চারযুগের সময়কালকে চৌদ্দভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রতিটি ভাগের নাম দেওয়া হয়েছে, 'মন্বন্তর'। তারই এক ভাগের অধিপতি হলেন স্বারোবিষ। অধিপতি হয়ে তিনি দেবী ভগবতী দুর্গার অনুগ্রহ ও আশীর্বাদ পেতে চাইলেন। তাই এলেন কালিন্দী নদীর তীরে। নদী তীরের মাটি দিয়ে নিজের হাতে গড়লেন শক্তিময়ী দেবী দুর্গার মূর্তি। সেই মূর্তি যথাবিহিত পুজো করলেন। কিন্তু, এবার এত সহজে দেবী তুষ্ট হলেন না। তখন স্বারোবিষ শুরু করলেন দেবীর তপস্যা। চলল দীর্ঘ বারো বছর। এবার দেবী তুষ্ট হলেন। সকাশে আবির্ভুত হয়ে স্বারোবিষকে অভীষ্ট বর দান করলেন। এই হল মাটির মূর্তিরূপে দেবীর দ্বিতীয় পুজো পাবার গল্প।
তৃতীয় গল্পটি অনেক কাল পরের। স্বারোবিষের পুত্র সাবনি তখন চৈত্ররাজবংশে জন্ম নিয়েছেন, তাঁর নাম হয়েছে, 'সুরথ'। সুরথ একবার শত্রুর হাতে রাজ্য হারিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। সেভাবেই হতাশ হয়ে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় পৌঁছে গেলেন 'মেধা'-নামের এক ঋষির আশ্রমে। সেখানে তাঁর সাক্ষাৎ হল 'সমাধি'-নামের এক বনিকের সঙ্গে। আলাপ করে জানলেন, সমাধি তাঁর চেয়েও হতভাগ্য। স্ত্রী-পুত্র তাঁকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে! ফলে, সমব্যথী ও সহদুঃখী দুজনে অচিরেই বন্ধু হয়ে উঠলেন। তারপর মেধা ঋষিকে প্রণাম করে জানালেন নিজেদের দুঃখের কাহিনি। তখন মেধা তাঁদের দীক্ষা দিলেন, কানে দিলেন নবক্ষর মন্ত্র। বলে দিলেন দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তির উপায়। মেধার কথায় সুরথ ও সমাধি কুশাসনে বসলেন। শুরু করলেন দেবীর আরাধনা। তবে তাঁরা কোন মূর্তি নির্মাণ করলেন না, বরং শুরু করলেন নিরাকার উপাসনা। সেই উপাসনা চলল বছরের পর বছর, তবুও দেবী তাঁদের সাক্ষাৎ দর্শন দিলেন না; দেখা দিলেন শুধু ধ্যানে। তখন তাঁরা আকুল হয়ে ত্রিকোণ এক যজ্ঞবেদী প্রস্তুত করলেন। তারপর সেই যজ্ঞের আগুনে নিজেদের শরীরের রক্ত ও মাংস আহুতি দিতে শুরু করলেন। এই কঠিন সাধনায় অবশেষে দেবী প্রসন্ন হলেন। সাক্ষাৎ দর্শন দিলেন। অনুগ্রহ করলেন। বর দিলেন সমস্ত দুঃখ-কষ্ট পেরিয়ে সুখসমৃদ্ধির।
সুতরাং, স্পষ্টই দেখা গেল যে, 'দেবী ভাগবত পুরাণ'-এর উপাখ্যানে সুরথ ও সমাধির মূর্তি নির্মাণেরই কোন উল্লেখ নেই। প্রথম তো নয়ই। উপরন্তু, তাঁদের উপাসনা যেন আদি-বৈদিক যুগের প্রকৃতি-আরাধনার মতো, বৈদিক ত্রিকোণ যজ্ঞবেদীতে প্রতীকী-যোনি পূজার মতো। তবে, 'মার্কণ্ডেয় পুরাণে'-এ সুরথ-সমাধিকেই দেবীর প্রথম মৃন্ময়মূর্তির নির্মাতা হিসেবে দেখানোর চেষ্টার মধ্যে একটি বিশিষ্টতা আছে। সেটি হল, দেবীকে আবাহনের মধ্য দিয়ে পুজোর কাহিনি এখানেই প্রথম রচিত হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, 'ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ'-এ প্রথম বলা হয়েছে দেবীর মৃন্ময়মূর্তি পুজোর পর বিসর্জনের কথা। 'দেবী ভাগবত', 'মার্কণ্ডেয়' ও 'ব্রহ্মবৈবর্ত'--এই তিন পুরাণ যিনিই লিখে থাকুন না কেন, চলে কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস-এর নামে। ফলে, এই কাহিনি ও বিধানের বিভিন্নতার দায়ভারও নিতান্তই তাঁর।