জগন্নাথ ধাম। সারা বিশ্বের জগন্নাথ ভক্তদের কাছে স্বয়ং ঈশ্বরের বাসভূমি। দারুদেব অধিষ্ঠান করেন এখানে। পুরীর জগন্নাথ মন্দির হিন্দুদের চার ধামের অন্যতম তীর্থ। মনস্কামনা পূরণের জন্য, কখনও বা শুধুই দেব দর্শনের জন্য জগন্নাথ-অনুরাগী মানুষ ছুটে আসেন পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে।
পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে কলিঙ্গের রাজা বিষ্ণুভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন দেব পুরীতে বিষ্ণুদেবের অর্চনার জন্য একটি মন্দির গড়ে তোলেন। বিষ্ণুর অন্যতম রূপ নীলমাধবকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁর সন্ধানে লোক পাঠান। বিদ্যাপতি নামে এক ব্রাহ্মণ ছিলেন সেই দলে। তিনি নীলমাধবকে খুঁজতে গিয়ে জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলেন। সেখানে শবররাজ বিশ্ববসুর কন্যা ললিতা তাঁকে উদ্ধার করে। সময় এগোলে ললিতা এবং বিদ্যাপতির বিবাহ হয়। পরবর্তী সময়ে বিদ্যাপতি জানতে পারেন তাঁর শবররাজ বিশ্ববসু জঙ্গলের মধ্যে গোপনে নীলমাধবের পুজো করেন।
বিদ্যাপতি তাঁকে অনুরোধ করেন নীলমাধবের দর্শন করানোর জন্য। জামাতাকে না বলতে পারেননি শবররাজ। কিন্তু শর্ত দেন মন্দির যাওয়ার পথে চোখ বেঁধে যেতে হবে। বিদ্যাপতি রাজী হন। কিন্তু পথ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি কৌশলে পথের মধ্যে সর্ষে ছড়াতে ছড়াতে যেতে থাকেন চিহ্ন স্বরূপ।
বিদ্যাপতি খবর পাঠান রাজার কাছে। ইন্দ্রদ্যুম্ন নীলমাধবকে উদ্ধার করতে সেই গুহায় পৌঁছালেও তাঁকে ফিরতে হয় খালি হাতে। কোথায় কী! কোথায়ই বা দেবতা নীলমাধব! গুহার মধ্যে রাজার জন্য ভেসে আসে দৈববাণী। রাজাকে বলা হয়, সমুদ্রের জলে ভেসে আসবে নিম কাঠ। সেই কাঠ থেকেই বানাতে হবে বিগ্রহ। হাজার হাজার হাতি,ঘোড়া, সেপাই, লোক-লস্কর নিয়েও সমুদ্র থেকে তোলা গেল না সেই কাঠ। শবররাজ এবং বিদ্যাপতি কাঠের দু’দিক ধরতে তবেই তোলা যায় কাঠ। দারুদেবের কাছে কোনও উচ্চ-নীচ নেই। ব্রাহ্মণ-শবর সব সমান।
জগন্নাথ ধামের সৃষ্টি সম্পর্কে আরও একটি কাহিনি আছে। কথিত আছে, যখন ভগবান কৃষ্ণ তাঁর নশ্বর দেহ ত্যাগ করেন, তখন তাঁর দাদা বলভদ্র এবং ছোট বোন সুভদ্রা খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন। এতটাই কষ্ট পেয়েছিলেন যে তাঁরা ভগবান কৃষ্ণের অর্ধদগ্ধ দেহ নিয়ে দ্বারকা শহরে সমুদ্রে ঝাঁপ দেন। একই দিনে রাজা ইন্দ্রদুম্ন স্বপ্নে দেখেন, ভগবান কৃষ্ণের দেহ পুরীর সমুদ্র সৈকতে কাঠের গুঁড়ির আকারে ভেসে উঠেছে। তখনই তিনি একটি মন্দির গড়ে তা জগন্নাথের উদ্দেশে উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেন।
জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ প্রসঙ্গে আরও দটি তথ্য পাওয়া যায়। সেই অনুযায়ী,
দ্বাদশ শতাব্দীতে এই জগন্নাথ মন্দির প্রথম নির্মাণ করেছিলেন পূর্ব গঙ্গা রাজবংশের তৃতীয় ত্রিকলিঙ্গ রাজা অনন্তবর্মণ চোদাগঙ্গা। তাঁর বংশধর দ্বিতীয় নরসিংহদেব নির্মিত কেন্দুপাটনা তাম্র-ফলকের শিলালিপি থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়।
প্রথম জীবনে রাজা অনন্তবর্মণ শৈব ছিলেন। ১১১২ খ্রিস্টাব্দে উৎকল অঞ্চল জয় করার পর তিনি বৈষ্ণব হয়েছিলেন।১১৩৪-৩৫ সালে একটি শিলালিপি পাওয়া যায়। সেই শিলালিপিতে তাঁর দান উল্লেখিত ছিল।
আর একটি মত বলে এই মন্দির দ্বিতীয় অনঙ্গভীম দেব দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। নির্মাণকাল ১১৯৬-১১৯৭-১২০৫-১২১৬, অন্য মতে ১২২৬। অনুমান করা হয় অনন্তবর্মণের পুত্র অনঙ্গভীমার রাজত্বকালে এই মন্দির সংস্কার করা হয়েছিল
বহু মত আছে মন্দির প্রতিষ্ঠা নিয়ে। ১১৬১ সালে বেলে পাথরে নির্মিত হয় মন্দির।
মন্দিরের চার দ্বার। উত্তর দ্বার,দক্ষিণ দ্বার,পূর্ব দ্বার ও পশ্চিম দ্বার।উত্তর দিকের দরজাটি হস্তীদ্বার। দক্ষিণ দিকের দরজা অশ্বদ্বার। পূর্ব দিকের দরজা সিংহদ্বার এবং পশ্চিম দিকের দরজা ব্যাঘ্র দ্বার।
জগন্নাথ মন্দিরের রত্নভান্ডার নিয়ে সাধারণের কৌতূহল অপার। মন্দিরের গোপন কক্ষে সাতটি ঘর আছে। সেই ঘরগুলিই হল রত্নভাণ্ডার। বহু বছর আগে মাত্র তিনটি ঘরের তালা খুলতে সক্ষম হয়েছিলেন মন্দিরের কর্মকর্তারা। বাকি ঘরগুলিতে কী আছে, তা আজও রহস্যই রয়ে গিয়েছে। শ্রীজগন্নাথের ‘ব্রহ্মবস্তু’র মতোই রত্নভাণ্ডারের রহস্য অধরাই রয়ে গিয়েছে।
যে কক্ষগুলি খোলা সম্ভব হয়েছিল, সেখান থেকে উদ্ধার হয় ১৮০ রকমের মণিমুক্তো খচিত স্বর্ণ অলঙ্কার। যার মধ্যে আছে মুক্তো, প্রবালের মতো অত্যন্ত দামী পাথর। এছাড়া, ১৪৬ রকমের রৌপ্য অলঙ্কার। তবে, এই সবই ‘ভিতর রত্নভাণ্ডার’-এর কথা। ‘বাহার ভাণ্ডার’-এর চিত্র কিছুটা অন্যরকম। পুরী শ্রীজগন্নাথ মন্দির আইন, ১৯৫২ অনুযায়ী রেকর্ড জানার অধিকারে ১৯৭৮ সালে তালিকা তৈরি হয়। সেই তালিকা অনুযায়ী, বাহার ভাণ্ডারে ১৫০ রকমের স্বর্ণ অলঙ্কার আছে। যার মধ্যে তিনটি স্বর্ণহার আছে। যার এক একটির ওজন প্রায় দেড় কেজি। শ্রীজগন্নাথ এবং বলভদ্রের স্বর্ণ শ্রীভুজ ও শ্রীপায়রের ওজন যথাক্রমে সাড়ে ৯ কেজি এবং সাড়ে ৮ কেজি। জগন্নাথ, বলভদ্র এবং সুভদ্রার স্বর্ণ মুকুটের ওজন ৭ কেজি, ৫ কেজি এবং ৩ কেজি। ১৯৭৮ সালের ১৩ থেকে ২৩ মে’র মধ্যে পুরী মন্দির প্রশাসনের তৈরি হিসেব অনুযায়ী, মণিমুক্তো খচিত ১২০ কেজি ৮৩১ গ্রাম স্বর্ণ অলঙ্কার, ২২০ কেজি ১৫৩ গ্রাম রৌপ্য অলঙ্কার, রুপোর বাসনপত্র সহ বিভিন্ন দামী বস্তু রত্নভাণ্ডারে পাওয়া গিয়েছে।