সতীপীঠঃ পূর্ণগিরিতে রয়েছেন সকল শিশুসন্তানের মঙ্গলকারিণী মা ‘মহাকালী’

উত্তরাখণ্ডের টনকপুর শহর। এই শহর ভারত ও নেপালের সীমান্তভূমিতে অবস্থিত। আর এখানেই রয়েছে অন্নপূর্ণা পর্বতশ্রেণি। এই পর্বতেরই একটি অনুচ্চ চূড়ার নাম হল, পূর্ণগিরি। এই গিরিশিখরেই রয়েছে দেবী সতীর একান্নপীঠের মধ্যে অন্যতম এক পীঠ। এই পীঠ পুণ্যতীর্থ, তাই এই পীঠধারী পূর্ণগিরিকে ভক্তজন ‘পুণ্যগিরি’ নামেও অভিহিত করেন। এই পীঠ সমুদ্রতল থেকে তিন হাজার মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। পীঠভূমির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে পুণ্যসলিলা শারদা নদী। প্রাচীন পুরাণগুলিতে এই নদীর কথা বর্ণিত হয়েছে।

কিংবদন্তি অনুসারে, ভগবান বিষ্ণুর সুদর্শনে কর্তিত হয়ে পুণ্যগিরিতে দেবী সতীর নাভি পতিত হয়েছিল। নাভি পতনের পর তা শিলায় রূপান্তরিত হয়। দেবীর এই শিলারূপ কীভাবে বা কখন প্রথম জনসমক্ষে এলো, কে-ই বা প্রথম পূজা করেন—সে-সব কথা জানা যায় না। তবে এটুকু জানা যায় যে, বহুযুগ ধরেই দেবী এখানে মহাকালীরূপে পূজিতা হন। কিন্তু দেবীর প্রকৃত ভৈরবের কোন হদিশ পাওয়া যায় না।

মূল টনকপুর শহর থেকে তেইশ কিলোমিটার দূরে এই পূর্ণগিরিস্থিত সতীপীঠ অবস্থিত। মন্দিরে পৌঁছতে হলে পূর্ণগিরির পাদদেশ থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার চড়াই করতে হয়। চড়াই করার জন্য পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত উচ্চ প্রবেশদ্বার পেরোলেই দুটি রাস্তা পাওয়া যায়। একটি সিঁড়িওয়ালা রাস্তা, অন্যটি সাধারণ। দু’পাশ দিয়ে দুটি রাস্তা ক্রমশ উপরের দিকে উঠে গেছে। দুটি রাস্তাতেই অসাধারণ মনোহর পাহাড়ি-প্রকৃতিসজ্জা পথিককে আমোদিত করে, বিস্মিত করে, বিমুগ্ধ করে। তবে এ-পথে বাঁদরের উপদ্রব থাকায় যাত্রীরা দলবেঁধে যাতায়াত করেন। যাই হোক, দু’কিমি এভাবে এগোনোর পর দুটি রাস্তা এক জায়গায় এসে মিলে যায়। যেখানে মেলে, সেখানে রয়েছে ‘ঝুটে কা মন্দির’ বা ‘মিথ্যুকের মন্দির’ নামে ছোট্ট একটি মন্দির। মন্দিরের এমন নাম কীভাবে হল, তা নিয়েও রয়েছে কিংবদন্তি। আর সেই কিংবন্তির সঙ্গে রয়েছে দেবী মহাকালীরও ঘনিষ্ঠ যোগ। কিংবদন্তিটি হলঃ

কোন এক কালে এক ধনী শেঠ ছিল দেবী শক্তির খুব ভক্ত। তা শেঠের ধনরত্নের তো অভাব ছিল না, অভাব ছিল সে-সবের ভোগীদার এক পুত্রের। আর সেই অভাবের কথা ভেবেই শেঠের মনে কষ্টের অন্ত ছিল না। ভক্তের এই কষ্টের কথা দেবীর অগোচর ছিল না। তাই হয়তো তিনি একদিন স্বেচ্ছায় সদয় হয়ে ভক্তকে কৃপা করতে চাইলেন। স্বপ্নে দেখা দিয়ে বললেন যে, শেঠ যদি পূর্ণগিরির পুণ্যস্থানে তাঁর নাভিপদ্ম দর্শন করে পূজা করে, তাহলে শেঠের একটি পুত্রসন্তান হবে। দেবীর কথামতো শেঠ পূর্ণগিরিতে গিয়ে অনেক কষ্ট স্বীকার করে দেবস্থানে গিয়ে ভক্তিভরে দেবীর পূজা করলো। দেবস্থানে দেবীর নাভির শিলারূপ প্রকট থাকলেও সেখানে কোন মন্দির ছিল না। তাই পূজার সময় শেঠ আবেগের বশে মানত করে বসল যে, পুত্রসন্তান হলে সে দেবীর একটি সোনার মন্দির বানিয়ে দেবে।

অল্পদিনেই দেবীর ইচ্ছেয় শেঠের পত্নী একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিল। পুত্র পেয়ে শেঠ কিন্তু হিসেব কষতে বসল। সে জাত-ব্যবসায়ী, তাই এক্ষেত্রেও হিসেব করে দেখল যে, সোনার মন্দির তৈরি করতে প্রচুর খরচ; অত খরচ করার কোন দরকার নেই। তাছাড়া দেবী নিজে তো আর মন্দির চাননি, তাই যেমন তেমন একটা মন্দির করে দিলেই হবে। ফলে, সে অনেক কম খরচে তামা দিয়ে একটি মন্দির তৈরি করিয়ে তাতে সোনালি রঙ করিয়ে দিল। শেঠের এই মিথ্যাচার দেবীর সহ্য হল না। জগতমাতা হয়ে তিনি শেঠ বা তার পুত্রের কোন ক্ষতি করলেন না বটে, তবে শেঠের এই মিথ্যা ছলনায় তাঁর দারুণ অভিমান হল। ফলে, শেঠ যখন ধুমধাম করে তাঁকে সেই মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করতে চাইল, তিনি তাতে অধিষ্ঠান তো করলেনই না, বরং মন্দিরটাই ঠেলে পীঠস্থান থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন। সেই থেকে দেবীর ত্যক্ত এই মন্দির ‘মিথ্যুকের মন্দির’ বলে ভক্তজনের কাছে উপেক্ষার বস্তু হয়ে রইল।

যাই হোক, এই মিথ্যুকের মন্দির পেরিয়ে আরও দেড় কিমি পথ পেরোলে তবেই পৌঁছন যায় মূল মন্দিরে। মন্দিরটি মার্বেল পাথরে তৈরি। মন্দিরের ভেতর লাল কাপড়ে নাভিপ্রস্তর ঢাকা থাকে। রক্তবস্ত্র, নৈবেদ্য, শৃঙ্গারসামগ্রী, তীব্রগন্ধী ধূপ, ধুম্র-শিখাময়ী দীপের সাজে ঢেকে থাকা গর্ভগৃহ ও দেবীর বেদি এবং গর্ভগৃহের ক্ষুদ্র পরিসরে উচ্চারিত মন্দ্রস্বরের মন্ত্রধ্বনি, কাঁসর-ঘণ্টার দুর্নিবার নাদ ভক্তজনের মনে এক অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি করে। দেবী যেহেতু শেঠের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছিলেন, সেহেতু ভক্তজনের বিশ্বাস, এখানে কাপড়ে গিঁট বেঁধে মানত করলে দেবী ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন। মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হলে আবার মন্দিরে এসে দেবীর সামনে সেই গিঁট খুলে দিতে হয়।   

ভক্তদের বিশ্বাস, পূর্ণগিরির এই মন্দিরে এসে শিশুদের মস্তকমুণ্ডন করলে এবং সেই মুণ্ডিত কেশ দেবীকে উৎসর্গ করলে দেবী নাকি সেইসব শিশুদের আয়ু বৃদ্ধি করেন উৎসর্গিত কেশরাশির সমান। বলা বাহুল্য, এই সব বিশ্বাসের প্রামাণিক কোন ভিত্তিই নেই। তবুও অসংখ্য ভক্ত এখানে তাঁদের সন্তানদের মস্তকমুণ্ডন করিয়ে দেবীর বেদিতে সেই সব কেশ উৎসর্গ করে থাকেন।

সারা বছর ধরে নানান উৎসব পূর্ণগিরির এই মন্দিরে ধুমধামের সঙ্গে পালিত হয়। তবে সবচেয়ে বেশি জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয় দুর্গা পূজা ও নবরাত্রি উৎসব। বছরের বিভিন্ন সময়ে বিশেষ পূজাও এখানে অনুষ্ঠিত হয়। সেই সময় মন্দির সজ্জিত হয় বিবিধ ফুল ও অজস্র দীপমালায়। চৈত্রমাসে অনুষ্ঠিত নবরাত্রি উৎসবের বিশেষ আকর্ষণ হল, মন্দির-সংলগ্ন স্থানে বসা জমাটি মেলা। এই মেলা চলে পাক্কা দু’মাস ধরে। ফলত, নিত্যপূজা ছাড়াও এই সব উৎসব ও বিশেষ পূজায় শামিল হতে দেশ-বিদেশের অসংখ্য ভক্তজন এই মন্দিরে নিয়মিত এসে ভিড় জমান; দেবী এবং অপার প্রকৃতির রূপ অন্তরে ধারণ করে তৃপ্ত হন।...    

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...
****/