ইংরেজ অধীন দেশ। প্রত্যন্ত কোনও গ্রামাঞ্চল। মানচিত্রের একেবারে মাঝামাঝি। একবছর বর্ষা মুখ ফিরে তাকালো না সেখানে। উপহার স্বরূপ এলো খরা। ফসল হারালো লাবণ্য। এদিকে ইংরেজ সরকার কে সময় মত চুকোতে হবে খাজনা। ফসল না ফললে, গরীব চাষীরা পয়সা পাবে কোথায়! বলা হয়, অলৌকিক ঘটনা অলৌকিক মানুষের উপস্থিতিতেই সম্ভব। এইরকম মুহূর্তেই জন্ম নেয় নতুন নায়করা। এক্ষেত্রেও হল তেমনটা। ভুবন নামের এক যুবক প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসলো ইংরেজ সরকার কে। প্রতিদ্বন্দ্বীতা হবে। খেলার। ক্রিকেট। তখনও অধুনা বিশ্বকাপ জয়ী ভারতবাসী শেখেনি কীভাবে ধরতে হয় ব্যাট, কীভাবে ছুড়ে দিতে হয় বল। তবুও বুকে সাহস ভর করে মাঠে কোমর বাঁধলো সকলে। বাকিটা এক স্মরণীয় অধ্যায় হয়ে থেকে গিয়েছে পৃথিবীর বুকে।
এই গল্প সেলুলয়েডের। কিন্তু বাস্তবের ইতিহাসও সাক্ষী থেকেছে এমন এক ঘটনার। সেখানে খেলাটা ফুটবল নিয়ে। ১৯১৪ সাল। পৃথিবীর ইতিহাসে আরম্ভ হবে এক লজ্জাজনক অধ্যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। চলবে আগামী চার বছর। বয়ে যাবে রক্তস্রোত। অগস্ট মাসে প্রথম বাজলো সমর শঙ্খ। জার্মানি যুদ্ধে নামলো শ্লাইফেন পরিকল্পনা মাফিক। ফ্রাঙ্কো-জার্মান সীমান্ত বরাবর জার্মান সেনারা আটকে দিতে পারলো ফরাসি সৈন্যদের। লক্ষ্য বেলজিয়ামের দ্রুততর একটা নিষ্পত্তি। ফ্রান্সকে এক প্রকার রুখে দিয়ে জার্মানদের পরবর্তী টার্গেট রাশিয়া।
অগস্টের শেষ দিকেই রাশিয়ার টানেনবার্গে রাশিয়ানদের উপর মিললো অত্যাশ্চর্য জয়লাভ। তখন একত্রিত হলো ব্রিটিশ এবং ফরাসি বাহিনী। ফলত, এবারে সম্ভব হলো জার্মান সেনাদের আটকানো। তখন ভরা শরৎ। এসন নদীর তীরে উভয় পক্ষই শুরু করলো একে অন্যকে ছাপিয়ে এগিয়ে যেতে।
একসময় যুদ্ধ হয় মুখোমুখি। প্রাণ হারান পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি। এক রক্তক্ষয়ী অধ্যায় এর রেশ কাটতে না কাটতেই চলে এলো রুক্ষ শীত। শুরু হল প্রকৃতির রাজত্ব। কিন্তু সকলের অজান্তেই এবারের শীত হতে চলেছে স্বর্ণোজ্জ্বল। প্রত্যেক সেনা শিবিরই তখন ত্রস্ত ও শ্রান্ত। এরকম ভয়াবহতা কেউই আগে দেখেনি। কারও শিশু মনের চাপা জিজ্ঞাসা কেন এই ধ্বংসের আয়োজন? কী এর উপকারিতা? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সভ্যতা আজও মুখ লুকোয়।
ততক্ষণে এসে গিয়েছে প্রভু যিশুর পবিত্র জন্মলগ্ন। ২৫ শে ডিসেম্বর। গোটা পৃথিবী সাজিয়ে নিচ্ছে নিজেকে ত্যাগের মাহাত্ম্যতে। উভয় সেনাবাহিনী চাইছে ক্ষণিকের যুদ্ধ বিরাম। তাই ইপ্রেসের চারপাশে ব্রিটিশ ও জার্মান লাইন বরাবর শুরু হবে ক্রিসমাস পালন। কিন্তু কীভাবে তা সম্ভব! সাক্ষরিত ও গৃহীত হল ক্রিসমাস ট্রুস। অর্থাৎ যুদ্ধ বিরতি।
যুদ্ধের নৃশংসতা ভুলে শুরু হলো আমোদ যাপন। সেনারাও অবকাশ পায় একটু শান্তিতে জিরোনোর। ভাগ্যহীন অস্বস্তিকর পরিবেশ। পাশাপশি ছিল বন্যার প্রবণতাও। আর সেই কারণেই সেনারা সিদ্ধান্ত নিলেন অবসর যাপন একমাত্র শ্রেয়। যুদ্ধের এ এক অন্য নজির। জার্মান সেনারা তৈরি করলো গানের ব্যান্ড। উত্তপ্ত যুদ্ধ ক্ষেত্র তখন শান্তির নিঃশ্বাস নিলো সুরের মূর্ছনায়। চলছে ধূমপান, খেলাধুলো। কারও কারও মনে তখনও অবিশ্বাস দানা বাঁধছে। হয়ত মনে হচ্ছে এ কোনও নতুন খান্ডপ্রস্থের ষড়যন্ত্র নয় তো? তবে সকল বিশ্বাস - অবিশ্বাস ছাপিয়ে সেদিন জিতেছিলো যুদ্ধ নয়, মানবতা।
প্রথম এগিয়ে আসে জার্মান শিবির। একটি ক্যারোল গান ধরে তারা। খিলান বরাবর সাজানো হয় ক্রিসমাস ট্রী। দিনে যুদ্ধ ক্ষেত্রে যারা বর্বর, একে অপরের রক্ত শুষে নিতে তৎপর, তারাই এখন ভরপুর বন্ধুত্বপূর্ণ কৌতুকে। এমনকি হয়েছে গানের লড়াই পর্যন্ত। পরের দিন সকাল জুড়ে চলে খাবার, তামাক ও উপহার বিনিময়। ওইদিকে মাঠে নেমে পড়েছে এক শিবির। সেখানেও যুদ্ধ। কিন্তু পায়ে পায়ে। অর্থাৎ সব খেলার সেরা বাঙালির সেই ফুটবল। তারপর নিশা ভোজন।
সময় থাকেনা থেমে। তাই ক্রিসমাস মরসুম এর হাওয়া একটু ফিকে হতেই আবারও হুংকার। শান্তিপূর্ণ ইঙ্গিতে পতাকা দেখিয়ে আবারও উভয় শিবির মুখোমুখি যুদ্ধক্ষেত্রে। তারপর ঘটনাক্রম বেদনাদায়ক এবং সকলেরই জানা। তাই সেটুকু আজ তোলা থাক। শতবর্ষে মানিকের সুরে বলা একটা জিজ্ঞাসা চলেই আসে তবে; ... তোরা যুদ্ধ করে করবি কী তা বল! সত্যি, খেলায় খেলায় যদি এভাবে রচনা হতো সব যুদ্ধের প্রেক্ষাপট! এই আক্ষেপ মানবজাতির।