অনেকেই ভাবতেন যে সত্যজিৎ বোধহয় আর্ট ডিরেক্টার হতে চান। 'অনেকেই' বলতে, সত্যজিৎ-কে যাঁরা সে-সময়ে চিনতেন কলকাতার সিনেমাপাড়ার স্টুডিও চত্বরে, তাঁরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন চিত্রপরিচালক ও ক্যামেরাম্যান নীতিন বসু ও তাঁর ইউনিটের কলাকুশলীরা।
আসলে, তাঁরা জানতেন যে, সত্যজিৎ ছবিটবি আঁকতে পারেন। আর্ট ডিরেক্টার হতে গেলে আঁকতে জানা আবশ্যিক।
হ্যাঁ যা বলছিলাম, 'পথের পাঁচালী' ছবি তৈরির অনেক আগে, 'রিভার' ছবির শ্যুটিং দেখতে যাবার অনেক আগে; সত্যজিৎ নিয়মিত শ্যুটিং দেখতে যেতেন কলকাতার স্টুডিও পাড়ায়। এই তথ্য আমরা জানতে পারছি সাতের দশকে 'কলকাতা' পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর সাক্ষাৎকার থেকে।
সত্যজিতের লেখা 'অপুর পাঁচালি'-তে 'পথের পাঁচালী'র শ্যুটিং-এর বিবরণ পড়লে মনে হতে পারে যে, শটের শুরুতে ডিরেক্টারকে 'অ্যাকশন' ও শট শেষে যে 'কাট' বলতে হয়--সেটাও বুঝি সত্যজিৎ জানতেন না। শ্যুটিং চলাকালীন বার বার আলোকচিত্রী সুব্রত মিত্র ও অন্য অভিজ্ঞ কলাকুশলীরা তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন শব্দ দুটো বলতে! কিন্তু, যিনি নিয়মিত ফ্লোরে গিয়ে শ্যুটিং দেখেছেন, তিনি 'অ্যাকশন'-'কাট' টার্মস দুটো জানবেন না, এ হতেই পারে না।
আসলে, প্রথম ছবির শ্যুটিং। নিজের ছবি। সব রকমের চাপ মাথায়। তাই আগে যতই শ্যুটিং দেখুন না কেন, সহকারী পরিচালক হিসেবে সরাসরি ফিল্ডে কাজ করার অভিজ্ঞতা তো তাঁর ছিল না। তাই হয়তো বার বার ভুলে যাচ্ছিলেন ও-দুটো শব্দ বলতে। ফলে, বার বার অন্যদের সেটা মনে করিয়ে দিতে হচ্ছিল।
যেটা আগে বলছিলাম, নিয়মিত নীতিন বসুর ছবির শ্যুটিং দেখতে যেতেন সত্যজিৎ। আসলে, নীতিন বসু ছিলেন সত্যজিতের আত্মীয়। তাই তাঁর শ্যুটিং ফ্লোরে অবাধ প্রবেশের অধিকার সত্যজিৎ সহজেই অর্জন করেছিলেন।
যাই হোক, সে-সময় নীতিন আর্ট ডিরেক্টার হওয়ার ব্যাপারে সত্যজিৎকে ক্রমাগত উৎসাহ দিয়ে চলেছিলেন। কিন্তু, সত্যজিতের মনে তখন চলছিল অন্য ভাবনা।
বক্ষ্যমাণ লেখাটাকে এবার একটা নিতান্তই সরল স্রোতে নিয়ে যাবার সময় এসেছে। সুতরাং, আসুন সিনেমা সম্বন্ধে সত্যজিতের পেশাগত আগ্রহ কী করে এল সেটা আগে আলোচনা করি:
প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় সত্যজিৎ প্রচুর সিনেমা দেখছেন, সিনেমার পোকা হয়ে উঠছেন; আর-পাঁচজন সিরিয়াস দর্শক যেমন হন, তেমনি; তার বেশি কিছু না।
কিন্তু, কলেজের পাঠ চুকিয়ে যখন শান্তিনিকেতনে আঁকা শিখতে গেলেন, তখন হঠাৎ করে পড়ার সুযোগ পেয়ে গেলেন সিনেমার টেকনিক নিয়ে লেখা বেশ কিছু ভালো বই। বইগুলো সেখানকার লাইব্রেরিতে ছিল।
তারপর কলকাতায় এসে 'ফিল্ম সোসাইটি' করলেন। এই ছাতার তলায় এসে জমলেন বিশ্ব-সিনেমা সম্পর্কে উৎসাহী বেশ কিছু যুবক। তাঁদের সঙ্গে সিরিয়াসলি সিনেমা দেখতে দেখতে সত্যজিৎ সিনেমার চিত্রনাট্য লেখার প্রতি একটা মারাত্মক টান অনুভব করলেন এবং এটাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করবেন বলে নিজেকে প্রস্তুত করতে লাগলেন।
প্রস্তুতির পাঠ হিসেবে যে-সব ছবিগুলো প্রথিতযশা সাহিত্যিকের লেখা গল্প-উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি হচ্ছে বলে সিনেমা-সংক্রান্ত ম্যাগাজিনগুলো থেকে জানতে পারলেন; সেই সব গল্প-উপন্যাস অবলম্বনে অন্তত দু'খানা করে চিত্রনাট্য রচনা করতে শুরু করলেন। একটা, বাজারি ধাঁচের অর্থাৎ চলতি স্রোতে পরিচালক যেমন করে গল্পটি ফাঁদতে পারেন, এই কথা ভেবে। আর অন্যটি, নিজে ছবি করলে যেভাবে করতে পারেন, সেই কথা ভেবে লেখা।
সত্যজিৎ এই দু'রকম চিত্রনাট্য রচনার ব্যাপারটাকে যেন পাঠক্রম হিসেবে নিয়েছিলেন। তাই ছবি রিলিজ করার সঙ্গে সঙ্গে সেই ছবির চিত্রনাট্যের সঙ্গে নিজের লেখা চিত্রনাট্যের গল্পসজ্জায় মিল কতখানি হল, সেটা মিলিয়ে দেখতেন। অনেক সময় কিছুটা মিলত, বেশিরভাগ সময়ই মিলত অনেকখানি। এভাবেই তিনি 'কালিন্দী' এবং আরও অনেকগুলো ছবির চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন।
দু'রকম চিত্রনাট্য রচনার পেছনে আরও একটা কারণ হয়তো ছিল, সেটা হচ্ছে, স্বাধীনভাবে চিত্রনাট্য রচনার পাশাপাশি বাজারি চাহিদা অনুযায়ী চিত্রনাট্য লিখে দেওয়ায় অভ্যস্ত হওয়া। পেশাদার চিত্রনাট্য-রচয়িতা হতে গেলে তো সব রকমের অভ্যাসই রাখতে হবে। কিন্তু অভ্যাসই সার, শিল্পের সঙ্গে আপোষ করা তাঁর স্বভাবে ছিল না। তাই ও-রাস্তায় এগোতে গিয়েও পারলেন না।
চারের দশকের প্রায় শেষ দিক। তখন রবীন্দ্রনাথের 'ঘরে বাইরে'-র চিত্রনাট্য লেখা হয়ে গেছে। বিলেত থেকে হরিসাধন দাশগুপ্ত সিনেমার কাজ শিখে এসে 'ফিল্ম সোসাইটি'র সভ্য হয়েছেন। সত্যজিতের সঙ্গে বন্ধুত্বও গড়ে উঠেছে।
হরিসাধন হঠাৎ একদিন শুনলেন যে সত্যজিৎ 'ঘরে বাইরে'-র চিত্রনাট্য লিখেছেন। আবদার ধরলেন শুনবেন। শুনলেন। ভারি পছন্দ হল। বললেন, ছবি করব। সত্যজিৎ বললেন, বেশ।
করিৎকর্মা হরিসাধন চটজলদি প্রোডিউসার জুটিয়ে ফেললেন। একরকম পাকা কথা হয়ে গেল।
তারপর প্রোডিউসারটি তাঁর এক 'শুভাকাঙ্ক্ষী' ও 'বুদ্ধিজীবী' ডাক্তার বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে চিত্রনাট্য শুনতে চাইলেন। সত্যজিৎ শোনালেন। ডাক্তার বন্ধুটি চিত্রনাট্যের কিছু পরিবর্তন প্রেসক্রাইব করলেন। সেটি আবার সত্যজিৎ কিছুতেই মানতে পারলেন না। হরিসাধন শত অনুরোধ করলেন, তবুও পারলেন না। ব্যাপারটা প্রোডিউসারের আঁতে লাগল। ফলে ছবির ভবিষ্যৎ গঙ্গালাভ করল। ফলশ্রুতিতে, সত্যজিৎ-হরিসাধন--দুই বন্ধুর মধ্যে স্বল্প মেয়াদে বাক্যালাপ বন্ধ হল।
সত্যজিৎ তবু দমলেন না।
ইতিমধ্যে বিমল রায় সাহিত্যিক সুবোধ ঘোষের 'ফসিল' গল্প নিয়ে ছবি করবেন শুনে সত্যজিৎ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। বললেন যে, ও গল্পের চিত্রনাট্য তাঁর লেখা আছে। রায়মশাই যদি সময় দেন, তাহলে শোনাবেন। বিমল রায় তাই শুনে সত্যজিৎকে ডাকলেন বটে, কিন্তু পাত্তা দিলেন না।
পাত্তা না-পান, এবারও সত্যজিৎ তেমন দমলেন না।
অল্পদিনের মধ্যেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বিলাসমন'টি ভালো লাগায় সেটি অবলম্বন করে সত্যজিত চিত্রনাট্য রেডি করে ফেললেন। 'উদয়ের পথে' ছবির লেখক জ্যোতির্ময় রায় তখন পুরোদস্তুর ছবির পরিচালক হয়ে উঠেছেন। তিনি খবরটি পেয়ে ছবি করবেন বলে সত্যজিৎকে একদিন ডাকলেন চিত্রনাট্য শোনার জন্য। সঙ্গে রইলেন তাঁর আগের ছবির প্রোডিউসার, যিনি কি না তাঁর আগামি ছবিরও হবু প্রোডিউসার। আর প্রোডিউসারকে গাইড করার জন্য প্রোডিউসারের সঙ্গী হলেন ক্যামেরাম্যান বিদ্যাপতি ঘোষ এবং চিত্রপরিচালক নীরেন লাহিড়ী।
সত্যজিৎ পরবর্তীকালে নিজের ছবির জন্য যেভাবে ডিটেলে নোটস রেখে রেখে চিত্রনাট্য লিখতেন, আগেও তাই করতেন। চিত্রনাট্য লেখার সময় এমনিতেই সিন থেকে সিনের ট্রানজিশনগুলো অর্থাৎ 'কাট', 'ফেড ইন', 'ফেড আউট', 'ডিসলভ' ইত্যাদি লিখতে হয়। সেটাই নিয়ম। তা, চিত্রনাট্য শুনতে শুনতে সেগুলো দেখেই প্রোডিউসার হঠাৎ বলে উঠলেন, 'শুনুন, এই যে ফেড আউট টেড আউটগুলো লিখেছেন, এগুলোর মানে বোঝেন?' বুঝুন কাণ্ড!
না, এরপর আর প্রফেশনাল স্ক্রিপ্ট রাইটার হবার বাসনা লালন করেননি সত্যজিৎ। এবার সত্যিই দমে গেলেন তিনি।
এসব গল্পের অবতারণা করলাম এই জন্য যে, দিবাস্বপ্নের মতো দুম করে 'পথের পাঁচালী' তৈরি করতে নেমে পড়েননি সত্যজিৎ। তার জন্য অনেক দিনের অধ্যবসায়, অনেক দিনের প্রস্তুতি, সিনেমা জগতের সঙ্গে দীর্ঘ যোগাযোগ, চিত্রনাট্যকার হিসেবে সেখানে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার লড়াই এবং লড়াই করতে গিয়ে অপমান, অপদস্থ হওয়া--কোন কিছুই বাদ ছিল না। যেমনটা আর-পাঁচ জন লড়াই করেন, তেমনটা তাঁকেও করতে হয়েছে। তার মধ্য থেকেই উঠে আসতে হয়েছে তাঁকে। রাখতে হয়েছে প্রতিভার স্বাক্ষর।