এক সামান্য মধ্যবিত্ত যুবক। ভালোবাসে একজন কে। রাষ্ট্রের কাজে যোগদান করে। অথচ সেই রাষ্ট্রই তাদের সম্পর্কের মাঝে হয়ে ওঠে একমাত্র বাঁধ। ভালোবাসা কিন্তু তখনও চুপ করে থাকেনা। ১৯৯১ সালে একটি পত্রিকা ছাপলো একটি সাদা-কালো ছবি। জার্মানির এক নৌসেনা ঘাঁটিতে হাজারো কর্মীর ভিড়। সবাই এক হাত তুলে অভিবাদন জানাচ্ছেন এক ঐতিহাসিক তারকা কে।
জার্মানি তখন ব্যস্ত নিজেকে বিশ্ব মানচিত্রে ক্ষমতার সমার্থক করে তুলতে। ১৯৩৬ সালের ১৩ জুন। উদ্বোধন হবে নতুন যুদ্ধ জাহাজের। স্থান হামবুর্গের নৌসেনার ঘাঁটি। সকাল থেকেই অন্য মেজাজে তোড়জোড়। কারণ উদ্ভোধন করতে আসছেন স্বয়ং রাষ্ট্র নায়ক। ভয় এর উর্দ্ধে উঠে ভয় দেখানো এক স্বৈরাচারী। কমিউনিস্টদের হাতে নিহত হয়েছেন ন্যাৎসি কর্মী হোস্ট হুইসেলন। নতুন যুদ্ধ জাহাজ হোর্স্ট হুইসেল তাঁর শহীদ স্মরণে। বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ঘাঁটির শ্রমিকদেরও। কীভাবে স্বাগত জানাতে হয় নেতা কে, রপ্ত করতে হবে সেই কায়দা।
এভাবেই প্রমাণ করতে হবে রাষ্ট্রের প্রতি প্রজার আনুগত্য। কয়েক’শো কর্মীর ভিড়। এক হাত তুলে ন্যাৎসি কায়দায় অভিবাদন জানাচ্ছেন সকলে। মঞ্চে তখন খাটো চেহারার সেই ব্যক্তি যিনি চাইলে হতে পারতেন আরও এক চার্লি চ্যাপলিন।এই ছবি জনৈক কোনও এক ফটোগ্রাফার ফ্রেম বন্দী করলেন। আর ফ্রেমবন্দী হল এমন একটা ঘটনা যা অদ্বিতীয়। যদিও সামান্য ছবি। আর প্রথম প্রথম চর্চায়ও আসেনি। ষাট বছর পর পৃথিবী জানতে পারে তাঁর বুকে ঘটে যাওয়া নীরব অথচ ভীষন বৈপ্লবিক ঘটনার।
সমস্ত কর্মী যখন চেনা ভঙ্গিমায় ওয়েলকাম করছেন হিটলার কে, তখন দাঁড়িয়ে আছেন একজন, দুই হাত গুটিয়ে। চোখে ও চেহারায় এক বিষণ্ণ বিদ্রোহী। পরোয়া করেননি রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু। শিরোনামে আসতেই শুরু হল ছবিটার ঐতিহাসিক ব্যাখ্যা যাচাই। বেরিয়ে এলো মর্মন্তুদ এক ভালোবাসার উপাখ্যান। অগস্ট ল্যান্ডমেসের। অত্যন্ত সাধারণ জার্মানি ছেলে। চাকরির আশায় ন্যাৎসি পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। গুলিয়ে ফেলেছিলেন রাজনীতি ও সমাজনীতি পরিপূরক নয়।
একদিন এই পার্টির কাজ করতে গিয়েই দেখা হয় ইহুদী মেয়েটির সঙ্গে। অগস্ট বোঝে ধর্মের নামে মানুষ হারাচ্ছে তাঁর অন্তরের সুন্দর কে। প্রেম হল ইরমা একল আর অগস্টের। খবর উঠল পার্টির কানে। এক জার্মানির মন কি না ইহুদী রক্তে ভেসেছে! বহিষ্কার হতে হল দল থেকে। শুধু এটুকুতেই ক্ষান্ত থাকেনি রাষ্ট্র। ঘোষণা হল বেআইনি হবে এদের পরিণয়। ততদিনে পৃথিবীতে এসেছে তাঁদের প্রথম সৃষ্টি। প্রথম কন্যা সন্তান ইনগ্রিড।
পরিবার তখন সামাজিক ভাবে ব্রাত্য। কাজ নেই, হাড়ি ফাঁকা। ভালোবাসায় পরিযায়ী হতে হয় মাঝেমাঝে। ঠিক হল দেশ বদলাবেন দুজনে। নতুন ঠিকানা ডেনমার্কের উদ্যেশ্যে হলেন রওনা। ওদিকে নেকড়ের মত ঘুরছিল ন্যাৎসি বাহিনী। জাতি বিদ্বেষ আইনে দোষী সাব্যস্ত হলেন আগস্ট। প্রমাণের অভাবে মুক্তিও পেলেন। বিনিময়ে রায় হল বেঁচে থাকতে গেলে ভুলতে হবে ইহুদী সম্পর্ক।
ভালোবাসাই তখন বিপ্লব। প্রকাশ্যেই থাকতে শুরু করেন তাঁরা। অন্ধ সমাজ আর জাতি বিদ্বেষকে তাঁরা পরোয়া করেনা। কিন্তু বাস্তবে কোন শক্তি বড়? রাষ্ট্র না মানবতা? মুখ লোকাতে হয় বারেবারে। রাষ্ট্র তখন হয়ে ওঠে প্রাণঘাতী। তেমনটাই ঘটলো এক্ষেত্রে। আবার গ্রেপ্তার হল প্রেমিক। পাঠিয়ে দেওয়া হল বোরজেরমুর কনসেন্টট্রেশন ক্যাম্পে। সেই শেষবার দেখে নেওয়া ভালোবাসার জ্যান্ত মুখগুলো। মেয়ে ইনগ্রিড এর মুখে পরে জানা যায় সেদিন পুলিশের গাড়ির পিছন পিছন ছুটতে ছুটতে রাস্তায় বসে পড়েন তিনি। রাষ্ট্র থামেনা। কালো ধোঁয়ায় মিলিয়ে যায় ভালোবাসা।
এই ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই গ্রেফতার হলেন ইরমা একলের। ইরমা তখন অন্তঃসত্ত্বা। ক্যাম্পেই জন্ম হয় দ্বিতীয় সন্তানের। নাম আইরিন। ধ্বংসের মুখেই নতুন প্রাণের চিৎকার। কিন্তু আলাদা হয়ে যেতে হল মা আর সন্তানদের। কী হল সেই মায়ের অন্তিম পরিণতি তা আর জানা যায়নি। বলা হয় প্রায় চোদ্দো হাজার লোকের সঙ্গে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পেই প্রাণ হারান তিনি। অনাথ শিবিরে তখনও বাড়তে থাকে মেয়েরা।
ততদিনে ছাড়া পেয়েছেন অগস্ট। খুঁজতে থাকেন স্ত্রীকে। কিন্তু সে যে নিশ্চিহ্ন! কেউ কিছুই বলতে পারল না। পৃথিবীর বাতাসে তখন আরও এক মহাযুদ্ধের ঋতু। অগস্ট কে নেওয়া হল সেনাদলে। ১৯৪৪ সালের ১৭ অক্টোবরে ক্রোয়েশিয়ার যুদ্ধ তাঁর জীবনের শেষ দাড়ি টানলো। দুই মেয়ে তখন ক্যাম্পের ভয়ঙ্কর স্মৃতি ভুলে আবার দেখতে পেরেছে আকাশ। ছবিটা দেখা মাত্র মেয়ে আইরিনই প্রথম চিহ্নিত করেন বাবাকে। এভাবেই অনেক অনেক ছোট ছোট ঘটনাও মুহুর্তের নিরিখে অমর হয়ে থাকে। ভালোবাসা কখনও হারেনি। কারণ হারতে দেননি অস্টের মত নির্ভীক যোদ্ধারা।