দুজনে একসঙ্গে প্রায় ৪০০ গান গেয়েছেন ডুয়েট জুটি হিসেবে। বেশির ভাগই হিট। সেই সংখ্যা এমনই যে কেউ যদি দুই জুটির সেরা গানের তালিকা তৈরি করতে বসেন তাহলে সার্চ ইঞ্জিনের সুবিধার যুগেও তা হবে বেশ বেগের ব্যাপার। জুটির নাম যে রফি আর লতা!
কারুর কারুর মুখে লতা-রফি, কিন্তু সেই হেরফেরে গান-সুরে গলে যাওয়া আটকায় না। দুই নামেই সমান মাদকতা। নেশার মতো টানে। প্রেম-সমর্পন-বিষাদ এক হয়ে যায়। একটাই তখন ঘরে ফেরার পথ। গান আর গান।
সেই পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সাঁঝ বাজারের ভরা ভিড়েও আপনি একলা হয়ে যাতে পারেন। হিসেবে ব্যস্ত দোকানীর হাত মুহূর্ত থমকে দাঁড়াতে পারে, সহকারী কিশোরটিকে বলে উঠতে, “এ গান শুনেছিস?”…
আর তখন এই এক মুহুর্তেই যাপন হয়ে যাবে হাজার বছরের বেঁচে থাকা। গায়ক আর শ্রোতার দু’পক্ষেরই। এমন মুহূর্তে অমর হয়ে যান সুরের দেবতা, হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন করে নেন উপমহাদেশের সুরের সরস্বতী।
রফি আর লতা দু’জন এভাবেই চেনে তামাম দুনিয়া। প্রেমের গানে তাঁরা যেন অবিচ্ছিন্ন। আলাদা করা যায় না। দুজনেরই দুজনের পারস্পরিক শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম। সেই শ্রদ্ধাবোধ না থাকলে এমনভাবে একসঙ্গে গাওয়া যায় না। গাওয়া গেলেও শ্রোতাদের কাঁদানো যায় না। দুজনেই সেরা, তবু তাঁদের সংঘাত নিয়ে গল্প কম শোনা যায় না।
১৯৬৩-১৯৬৭ টানা চারবছর একসঙ্গে ডুয়েট বন্ধ ছিল তাঁদের। শোনা যায় নেপথ্যে নাকি গানের রয়্যালিটি নিয়ে সমস্যা।
তবে রফির প্রতি লতার শ্রদ্ধা ছিল সীমাহীন। সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রফির প্রসঙ্গে এলে বলতেন তাঁদের পুরনো দিনের কথা।
গান রেকর্ডিং-এর সময় ভীষণ ভালো বুঝতেন একে ওপরকে। মন পড়তে পারতেন। তাই গানে এক্সপ্রেশন অমন মধুর হয়ে উঠত। নৌশাদ, শচীনদেব বর্মন, কল্যাণজি-আনন্দজি, সুরকার-গীতিকার যেই হোক না কেন গানের গায়ে শুধু যেন লেখা থাকত রফি-লতারই নাম।
রফি সম্পর্কে বলতে গিয়ে লতা বলেন, “লোকে বলে রফি সাবের সঙ্গে আমার গাওয়া ডুয়েট সেরা। আমি কিশোরদা, মুকেশ ভাইয়া দুজনের সঙ্গে ডুয়েট গেয়েছি, কিন্তু আমায় স্বীকার করতেই হবে যে ওই রেঞ্জ, সাত সুরের ওপর নিয়ন্ত্রণে রফি সাব অসাধারণঃ।
কেমন ছিল তাঁদের রেকর্ডিং-এর দিনগুলো। সেই গল্প বলতে গিয়ে লতা স্মৃতি হাতড়ে তুলে আনেন মনি-মুক্তো। তাঁর দেখায় “রফি ছিলেন সিরিয়াস স্বভাবের মানুষ। রেকর্ডিং-এর সময় কিশোরদার মতো এমন ‘মস্তি’তে মাতাবেন চত্বর মাতাবেন ভাবাই যেত না”। স্টুডিয়োতে গান রেকর্ডিং থাকলে রফি সাহেব একেবারে চুপ থাকতেন। শান্ত, ধীর মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই, একটু পরেই কীভাবে বয়ে যাবেন ঝর্ণাধারায়। মৃদুভাষী সজ্জন। একেবারে মাটির মানুষ। কেউ কথা বললে উত্তর দিতেন।
গুরুত্ব দিতেন রিহার্সালে। সব কিছু একেবারে নিখুঁত হওয়া চাই। নাইটেঙ্গেলের চোখে রফি সাব গান গাইতেন না, তাঁর কাছে গান গাওয়াটা ছিল সাধনা। ঈশ্বরের কাছে ঠিক যেভাবে আকুল হয়ে প্রাথর্না করে মানুষ, ঠিক সেভাবে গাইতেন। আমিও আমার কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস থাকতাম, কিন্তু তাঁর ডেডিকেশন ছিল অন্য মাত্রার। একেবারে সন্তের জীবনে থাকতেন”।
লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে মহম্মদ রফির জান-পেহচান দীর্ঘদিনের। তখনও পায়ের তলায় মাটি খোঁজার লড়াই চলছে। তাঁর ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরের সঙ্গে মহম্মদ রফির সম্পর্ক তখন থেকেই বেশ কাছের। ১৯৫২-তে তৈরী বৈজু বাওরা ছবির ‘সাচো তেরো নাম’ গানটিতে নৌশাদের ডাকে রফির সঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন শিশু কণ্ঠশিল্পী হৃদয়নাথ।
এই একই ছবিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন লতাও। শিশু বৈজুর কণ্ঠে ভাই হৃদয় আর তার সঙ্গিনীর ছোটবেলার গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন লতা। তখনও রফি-রফিই...
মহম্মদ রফির সঙ্গে তাঁর অজস্র সেরার মাঝে ‘তাজমহল’ ছবির ‘পাঁও ছুঁ লেনে দো’ গানটিকে একেবারে প্রথমের দিকে রাখেন লতা। তারপরেই ‘ক্যারাভান’ ছবির ‘কিতনা প্যারা ওয়াদা হ্যায়’...এগুলো শুধু কয়েকটা, এমন অজস্র আছে।
মাত্র ৫০-এ চলে যান মহম্মদ রফি। লতার আর দুই প্রিয় গায়ক মুকেশ আর কিশোরের চলে যাওয়া আচমকাই। নিজের সহকর্মীদের লতা ভুলতে পারেননি। দিলীপ কুমার আর রফি কবেই যেন মিলেমিশে গিয়েছিল তাঁর কাছে। তাঁর কথায়, গানের ভাষাই আসলে ছিল রফির জীবনের ভাষা, সেই ভাষাতেই তিনি কথা বলেছেন সারাজীবন। শ্রোতাদের সঙ্গে, ঈশ্বরের সঙ্গে… তাঁর সহকর্মীরা সেই কথোপকথনের দোসর…
তথ্যসূত্রঃ ( ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ফিল্মফেয়ার ম্যাগাজিন)