সময়টা উত্তাল চল্লিশ। বার্মা আক্রমন করেছে জাপান। দলে দলে ঘর ছাড়ছে মানুষ। চেনা ভূম ছেড়ে অচেনা দিকে। তেমনি এক দলে ছিলেন জর্জ ডেসমায়ারের পরিবারও। স্ত্রী আর দুই সন্তান। সঙ্গী বলতে তাদের মতো হাজার হাজার ঘর ছাড়া মানুষ।
মাইলের পর মাইল পার। মাঝে সরে যায় গ্রাম, পাহাড়, জঙ্গল। অনাহার,অসুস্থতা। আর ও কত ভয়। তবু থামার উপায় নেই।
পথ যত এগোয় তত কমতে থাকে দলের মানুষগুলোর সংখ্যা। পথ চলতে গিয়ে গর্ভের শিশুকে হারায় মা। তবু পা থামার উপায় নেই।
হাঁটতে হাঁটতে তারা এসে পৌঁছল ডিব্রুগড়ের উদ্বাস্তু শিবিরে। হাসপাতালে ভর্তি হল দুই ভাই বোন। রজার আর হেলেন। দীর্ঘ অসুস্থতার পর সুস্থ হয়ে কলকাতায়।
কলকাতায় ভর্তি হয়েও নিস্তার নেই। স্মলপক্সে মৃত্যু হল ভাই রজারের। হেলন একা। স্কুলে ভর্তি হয়েও ছাড়তে হল স্কুল।নুন আনতে পান্তা ফুরনের সংসারে স্কুলের বেতন বোঝার মতো। সেই ভার বহন করতে পারেননি মা।
১৯৪৩-এ মুম্বই পাড়ি। তখন বোম্বাই। ্মা নার্সের চাকরি নিলেন হাসপাতালে। আবার বিয়ে করলেন এক ব্রিটিশ সেনাকে। তাঁর নামেই মেয়ে হেলেনের নাম হেলেন জেইরাগ রিচার্ডসন।
ছোটবেলার ঝড়ঝাপটা খুব তাড়াতাড়ি পরিনত করে দিয়েছিল হেলেনকে। বুঝেছিল একটা চাকরির খুব জরুরি দরকার। পাশে দাঁড়ালেন বন্ধু কাক্কু মোরে। নাচের দলে কোরাস ডান্সার হিসেবে কাজ জুটে গেল একটা।
১৯ বছর বয়সে প্রথম বড় ব্রেক। ‘হাওড়া ব্রিজ’ ছবিতে ‘মেরা নাম চিং চিং চু’ দারুণ জনপ্রিয়তা পেল। হিট হলেন সেই গানের ঝটফটে নৃত্যশিল্পীও।
চড়চড়িয়ে বাড়তে লাগল হেলেনের জনপ্রিয়তা। অবস্থা এমন যায়গায় পৌঁছলে যে কোথাও যেতে গেলেই আপাতমস্তক ঢেকে বেরতে হয় । যাতে কোনওভাবেই চিনতে না পারে মানুষ।
২৭ বছর বয়সে বিয়ে করেন পিএন অরোরাকে। ১৬ বছর একসঙ্গে থাকার পর হেলেনের এক জন্মদিনে আলাদা বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। পিএন-এর বিরুদ্ধে হেলেনের অভিযোগ ছিল টাকা তছরুপের।
তাঁর ঋণের দায়ে অবস্থা এমনই দাঁড়ায় যে হেলেনের অ্যাপার্টমেন্ট সিজ করা হয়।
একদিকে যখন ভাঙনের ঢেউয়ে তোলপাড় হচ্ছে জীবন তখন অন্যদিকেই খুব নীরবেই বইতে শুরু করেছিল নতুন বসন্তের বাতাস।
১৯৬২-তে ‘কাবিল খান’ ছবির সেট। আলাপ হল এক চিত্রনাট্যকারের সঙ্গে। ছবিতে হেলেন ‘লিড অ্যাকট্রেস’। চিত্রনাট্যকার ভূমিকা নেগেটিভ রোলে। ভালো বন্ধু হয়ে গেলেন তাঁরা।
দুজনকে ফের একসঙ্গে দেখা গেল ‘তিসরি মঞ্জিল’ ছবিতে। ‘ও হাসিনা জুলফোওয়ালি’ ব্লকব্লাস্টার হিট!
ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব বদলে গিয়েছিল প্রেমে। ১৯৮১-তে পরিনয়ে বাঁধা পড়লেন তাঁরা। সেলিম তখন বিবাহিত। তিন সন্তানও আছে। সেও এক ঝড়। ঝাপটা খেতে হয়েছিল তিনজনকে। সেলিম। হেলেন। আর সালমা খান।
সন্তানদের ওপরও প্রভাব পড়েছিল। তবে পরে ঝড় থেমে যায়।
হেলেন আর সেলিম এক কন্যাকে দত্তক নিয়েছিলেন। নাম অর্পিতা।
১৯৮৩-তে বলিউডের মূল স্রোত থেকে সরে আসেন। কিন্তু ছবির দুনিয়া এক মুহুর্তের জন্যও ভোলেনি তাঁকে। ‘হাম দে চুকে সনম’, ‘মহব্বতেঁ’ ছবিতে ফিরে এসেছিলেন। ‘মহব্বতেঁ’ ছবিতে শাহরুখের সঙ্গে নাচের ছন্দে পা মিলিয়ে ছিলেন। দেখে বোঝার উপায় ছিল না যে ১৭ বছর দূরে ছিলেন শুটিং ফ্লোর থেকে।
হেলেন মানেই উজাড় করা গ্ল্যামার আর পর্দায় এলেই চোখ পোড়ানো আগুন। কিন্তু সেই আগুনের আড়ালে এত যে রক্তপাতের কাহিনি তার খবর লাইমলাইট রাখেনা। হেলেন কিন্তু ভুলতে পারেনি উদ্বাস্তু হাসপাতালের দিনগুলো। তাই আজও পুরস্কারের মঞ্চে দাঁড়িয়ে ফিরে ফিরে আসেন সেই কাহিনির কাছেই। সিনেমার থেকে কম যায় না সেই চিত্রনাট্যও।