নির্দেশিকা নন্দিতার চোখে মান্টো

বাস্তব যখন লাগাম ছাড়া হয়ে পড়ে, তোয়াক্কা করেনা অদৃষ্টের, মানুষ যখন তার হাতের পুতুল; তখন তার রক্তচক্ষু তে লজ্জার আবির ছিটিয়ে দিতে প্রয়োজন শক্ত কলমের, দৃঢ় স্বরের। যে স্বরের মালিক শুধু নিজের ভিতরের আবাহনে নড়ে ওঠেন। তাঁর তুলনা টানা যেতে পারে বাংলার ঋত্বিকের সঙ্গে। ঋত্বিক ঘটক। দেশভাগের জ্বালা যাঁর জীবনে টেনে এনেছিল মৃত্যুর অভিলাষ। মান্টো বাস্তবের গল্পকার। বাস্তবের অভিজ্ঞতা, চরিত্ররা আনাগোনা করেছে তাঁর এগল্প থেকে সে নাটকে।

সাদাত হাসান মান্টো। সে মানে না কাঁটাতারের বাঁধন। সেই ভাঙন অন্য ছকে এঁকেছেন পরিচালক নন্দিতা দাস, তাঁর ‘মান্টো’ ছবিতে। নামভূমিকায় নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি। তিনি যেন অতিরিক্ত আবেগের বলয়ে আরও জীবন্ত করে তুলেছেন চরিত্রটিকে। শুধু মান্টো নয়, তাঁর মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে অন্য মানুষের অনেক কথা যা সেই সময়ের যন্ত্রণাকে ফুটিয়ে তোলে। মেটাননি পান ওয়ালার বকেয়া এক টাকা। তাহলে মিটে যেত সেই শহরের সঙ্গে তাঁর নাড়ির যোগাযোগ। আবেগ বিচার হতো অর্থের মূল্যে।

নন্দিতা তখন কলেজ পড়ুয়া। প্রথম পরিচয় ঘটে স্বাধীনচেতা এক লেখকের সঙ্গে, বইয়ের পাতায়। তাঁর নাম মান্টো। আত্মার যোগাযোগ পুরোপুরি সম্ভব হয়ে ওঠেনি তখনও। অথচ দ্যোতনায় ভরা লেখাগুলো তাড়িয়ে ওঠে শিল্পী মনকে। ছবির চিত্রনাট্য রচনার সময় লেখক মান্টোর চেনা পথেই হেঁটেছেন তিনি। নিজের পৃথিবীকে যেমন ভাবে দেখেছেন, অনুভব করেছেন, কোনও অলংকার ছাড়াই সেই স্বরূপ এঁকেছেন গল্পের বুননে। সাল ২০১২ ছিল তাঁর জন্ম শতবর্ষ। হুড়োহুড়ি লেগেছিল তাঁকে নিয়ে লেখায়। তার আগে এবং পরে! অথচ তিনি চিরকালীন প্রাসঙ্গিক।

নন্দিতার মতে, সেটাই তাঁকে আরও এক ধাপ কাছাকাছি নিয়ে যায় মান্টোর। বুঝতে পারেন সেই সময়ের যন্ত্রণা তুলে ধরা উচিত আজকের প্রজন্মের কাছে। সামাজিক নৃশংসতাকে নৃশংস রূপেই ধরেছিলেন নিজের প্রতিটা গল্পে মান্টো। তাই থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল কলম, মাত্র বিয়াল্লিশে। এই ছবিতে শুধু লেখক মান্টো নন, লেখার আড়ালের মান্টো কেও তুলে ধরতে চেয়েছেন নির্দেশক। তাঁর গল্প বলার মধ্য দিয়ে আজকের নির্দেশক বর্তমান সময়কেও দাঁড় করিয়েছেন কাঠগড়ায়। আজকের ছবি কোনও অংশেই আলাদা নয়। আজও নেই বাক স্বাধীনতা। আজও ধর্মের নামে হয় রক্তপাত।

নির্মাণকালে বিশেষ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় নি। শুধুমাত্র চরিত্রের আত্মার নির্মানটাই ছিল মূল। একেই চলে গিয়েছেন সময়ের আগে, তাই বেশি মানুষের সংস্পর্শেও হয়নি আসা। সর্বদাই হেঁটেছেন স্রোতের বিপরীতে। নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলেন সমকালীন ধারাপাত থেকে। কাজেই ব্যক্তি মান্টো কে চিহ্নিত করতে পারাটাই ছিল চ্যালেঞ্জ। দেশবিভাগের পর সদ্য জন্মানো ভারত এর পিঠে তখন অর্থের বোঝা। আমরা - ওরা রাজনীতির সেই শুরু। আর্থ সামাজিক চেহারা ক্ষীণতর। তাও সাবালিকা হয়েছে ভারত মা।

তবুও সমস্যার অবয়ব আজও একই আছে। আর তখনই এগিয়ে এসে কথা বলতে হয় শিল্প কে। নন্দিতাও তাই চেষ্টা করেছেন। তাঁর বিশ্বাস শিল্প বিভেদের দেওয়াল নয়, তৈরি করে মিলনের সাঁকো। এই মাসেই তাঁর জন্মদিবস। চলে গিয়েছে সেই দিন। কিন্তু যায়নি ভিতরটাকে বদলে ফেলার সময়। মুহূর্ত এখনও অবশিষ্ট।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...