শিব স্বয়ং পার্বতীকে বলেছিলেন দানরুচি ব্রাহ্মণের উপাখ্যান ও ব্রাহ্মণ মাহাত্ম্য!

শিব পুরাণের সনৎ কুমার সংহিতার একাদশ অধ্যায়ে শিব কর্তৃক ‘ব্রাহ্মণ মাহাত্ম্য কথন’ বলে একটি অধ্যায় আছে। যেখানে ব্যাসদেব মুনিবর সনৎ কুমারকে প্রশ্ন করেন, দেবাদিদেব মহাদেব পার্বতীর সাথে হিমালয় শৃঙ্গে গমন করার পর কী করেছিলেন? তখন সনৎ কুমার তার উত্তরে বলেন, “কৈলাসে পার্বতী মহাদেবকে প্রণাম করবার পর বললেন যে নৈমিষারণ্যে হিরণ্য নামে উচ্চ বৃত্তিজীবী এক ব্রাহ্মণ আছেন। এই ব্রাহ্মণ শুচিতা, ভক্তি, শ্রম,সংযম গুণে ভূষিত। আমি সেই ব্রাহ্মণের পূজা গ্রহণ করতে গিয়েছিলাম। সেই তপস্বী ব্রাহ্মণের মাহাত্ম্য দেখে বিস্মিত হয়েছি আমি। আমার বিবেচনায় এই  ব্রাহ্মণ দেবতা থেকেও শ্রেষ্ঠ। আমি তাঁর মাহাত্ম্য কথা শুনতে চাই। আপনি কৃপা করে তা বলুন।”

মহাদেব তখন দেবী পার্বতীর কৌতুহল নিবৃত্তি করতে বললেন, “হে প্রিয়ে তুমি ঠিকই বলেছ তপস্বী ব্রাহ্মণ দেবতা থেকেও শ্রেষ্ঠ। সৃষ্টির আদিতে একমাত্র আমিই প্রকাশমান ছিলাম। আমি রুদ্রতেজ বিশিষ্ট ব্রাহ্মণদের সৃষ্টি করি। পরে ব্রহ্মা সৃষ্টি করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তিনি তার মস্তক থেকে ব্রাহ্মণগণকে সৃষ্টি করেন। আমার সৃষ্ট ব্রাহ্মণগণ অগ্রবর্তী ও শ্রেষ্ঠ। এই ব্রাহ্মণগণ আমার চিন্তায় রত। ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই চারটি বর্গ ব্রাহ্মণগণেই প্রতিষ্ঠিত। ব্রাহ্মণগণ‌ই যজ্ঞ, হোম ও হবিঃ। এই হবিঃ দ্বারাই দেবতারা তৃপ্তি লাভ করেন। ব্রাহ্মণদের হিতেই সমগ্র জগৎ প্রতিষ্ঠিত। আমি সেই ব্রাহ্মণদের লক্ষণ বর্ণনা করছি। ব্রাহ্মণ জন্মই সংস্কার হেতু। সংস্কার বা উপনয়ন‌ই দ্বিজ নামের হেতু। বিদ্যা ও বেদ পাঠ বিপ্র নামের হেতু। সুতরাং ব্রাহ্মণ ত্রিবিধ।  যে ব্যক্তি জন্ম ও সংস্কারের  দিক থেকে সর্বশাস্ত্র বিশারদ ও তপশ্চর্যাসমন্বিত তার নাম ত্রাব। হে দেবী যে ব্রাহ্মণ বেদ পরায়ন ও যঞ্জ পরায়ণ তিনিও শ্রেষ্ঠ। পূজিত হলে তিনিও মানুষকে পাপ হতে নিস্তার করতে সক্ষম। যে ব্যক্তি শুধু জন্মত ব্রাহ্মণ তিনিও পূজিত হলে ভক্তের অভিষ্ঠ পূরণ করতে পারেন। তিনিও লোক গুরু এবং তার পুজো করে পুণ্য লাভ করা যায়। অগ্নিহোত্র, তপস্যা, যোগ, শৌচ, ঋজুতা, সত্য এবং বেদানুশীলন‌ই ব্রাহ্মণের কার্য। ব্রাহ্মণ প্রাণী হত্যা করেন না, ব্রাহ্মণ সেবা করেন না, ব্রাহ্মণ পাপ করেন না। চন্দ্র-সূর্য প্রভৃতি আমার যে অষ্টমূর্তি আছে তা ব্রাহ্মণ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। অতি ক্লিষ্ট ও দরিদ্র ব্রাহ্মণও দান করতে সমর্থ। মহাতেজ দ্বিজগণের অসাধ্য কিছুই নাই। তারা ক্রুদ্ধ হলে অশুভ ফল হয়, তারা প্রসন্ন হলে শুভ ফল পাওয়া যায়। সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিন গুণের মধ্যে সত্ত্ব গুণ মোহনাশ করে। এই সত্ত্বগুণ ব্রাহ্মণদের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত।”

মানে দেবাদিদেবের কথায়, ব্রাহ্মণ দেবতা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। কিন্তু  ব্রাহ্মণের চরিত্র কীরূপ হবে?  দেবাদিদেব মহাদেবের কথায় ব্রাহ্মণ সর্বদাই সত্যে স্থির থাকেন এবং তিনি সত্ত্বগুণের অধিকারী। তিনি কখনও পাপ করেন না। ব্রাহ্মণ দানশীল হন, সব থেকে দরিদ্র ব্রাহ্মণ‌ও অনায়াসে  দাতার ভূমিকা পালন করে থাকেন। আর এই সকল সদগুণের আধার হওয়ার কারণেই  ব্রাহ্মণ পূজিত হন। 

এরপর দেবাদিদেব মহাদেব পরম ধার্মিক এক ব্রাহ্মণ দানরুচির উপাখ্যান শুরু করেন। যিনি উঞ্ছবৃত্তি অবলম্বন করে জীবনযাপন করতেন। তিনি সর্ববিদ্যা সম্পন্ন ছিলেন অথচ কখনও তার মধ্যে কোন উদ্ধতভাব তৈরি হত না। তার স্বভাব সর্বাবস্থাতেই ছিল শান্ত। তিনি ছিলেন সমদর্শী এবং সকল প্রাণীর অভয় দাতা। তিনি প্রতিদিন পত্নীর সাথে হোম কার্য করতেন এবং তারপর গৃহে আগত অতিথিদের ভোজন করিয়ে নিজে ভোজন করতেন। প্রতিদিনই তার গৃহে কোনও-না-কোনও অতিথি আসত। গৃহে কোন অতিথি এলে আতিথ্য বিষয়ে তার কোনও দ্বিধা বা কার্পণ্য কখনই ছিল না এইভাবে বহুকাল অতিবাহিত হয় এবং তার ঋজু স্বভাব, তপস্যা ও অতিথি সেবার কারণে তিনি সূর্য ও অগ্নি অপেক্ষা তেজস্বী হয়ে ওঠেন। এরপর দানরুচির তপস্যায় তুষ্ট হয়ে অগ্নিদেব অভিলাষিত বর দান করতে চাইলেন, কিন্তু বরদান করবার আগে তিনি দানরুচির পরীক্ষা নিতে চাইলেন। সেই দিন দান রুচির গৃহে কোনও অতিথি এল না, ভোজন কাল অতীত হলেও কোন অতিথি না আসায় দানরুচি বিব্রতবোধ করতে শুরু করলেন এবং দিবসের ষষ্ঠ ভাগ অতীত হাওয়ায় ব্রাহ্মণ দান রুচি হিমালয়ের দারুণ শীত অগ্রাহ্য করে বাইরে গিয়ে অতিথির খোঁজ করতে লাগলেন। তার সুযোগ্য পত্নীও পতি দানরুচির যোগ্য সহধর্মিনী ছিলেন, তিনি স্বামী যা করতেন তাই করতেন, তাই স্বামীকে অনুসরণ করে তিনি উপবাসী রয়ে গেলেন।  দানরুচি উপবাসী অবস্থায় হিমালয় প্রদেশে ঘুরে ঘুরে অতিথির খোঁজ করতে লাগলেন। ব্রাহ্মণের অতিথিসেবায় আগ্রহ ও অধ্যবসায় দেখে অগ্নিদেব স্বয়ং এক কুৎসিত  চন্ডাল রূপ ধারণ করে গাছের তলায় এসে বসলেন। সেই চন্ডালের গোটা শরীর জুড়ে ছিল ক্ষত এবং ক্ষতস্থান থেকে রক্তের সাথে কৃমি নির্গত হচ্ছিল। রোগ-যন্ত্রণায় কাতর হয়ে সে "হে পিত হে পিত" বলে আর্তনাদ করছিল। আচমকা ব্রাহ্মণের নজর তার দিকে যায় এবং তিনি করুণায় বিগলিত হয়ে তাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন," হে ভদ্র ভয় নেই"-এই  বলে তিনি তৎক্ষণাৎ সেখানে আগুন জ্বেলে চন্ডালের শীত নিবারণ করলেন এবং তারপর তাকে তার ঘরের অন্ন ভোজন করার জন্য আহ্বান জানালেন। তখন চন্ডাল রূপী অগ্নিদেব  বললেন, "আমি চন্ডাল জাতি। মৃগ ও ও পক্ষীর মতো বনেই আহার করি। আমি কোন ব্রাহ্মণ গৃহে অন্ন ভোজনের যোগ্য নই।" চন্ডালের এই কথা শুনে দানরুচি ধ্যানে বসলেন তিনি ধ্যানযোগে জানতে পারলেন এই চন্ডাল স্বয়ং অগ্নিদেব। চন্ডাল রূপ ধারণ করে তাকে দর্শন দান করেছেন। তখন ব্রাহ্মণ চন্ডালকে বললেন," হে মহাশয় আমি চন্ডাল বা কোন জাতির পূজা করব না। যিনি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল প্রাণীর মধ্যে সমানভাবে বিরাজ করেন সেই পরম মঙ্গলময় আত্মাকে আপনার মধ্যে দিয়ে পুজো করব। সেই আত্মায় সর্বশ্রেষ্ঠ। এই আত্মা এক হয়ে বহু রূপে বিরাজ করে। সেই এক পরমপুরুষ সর্বত্র এবং সকল জীবের মধ্যে বিদ্যমান। এই জন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল প্রাণী‌ই  আমার কাছে দেবতা স্বরূপ। সুতরাং আপনি কোনরূপ কুন্ঠা বোধ করবেন না। কুৎসিত ও অকুৎসিত জীবে আমার কোনও ভেদ জ্ঞান নেই। আত্মা সর্বগত সেই সর্বগত এক আত্মা যেমন দ্বিজ জাতির মধ্যে আছে, তেমনি সকল জাতির মধ্যেই রয়েছে।  তাই আপনি আমার গৃহে আসুন। আমি শুচিশুদ্ধ তপোনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ হয়েও আপনার পুজো করি। আপনি আমার গৃহে অন্ন ভোজন করে আমাকে পবিত্র ও ধন্য করুন।"  ব্রাহ্মণের এই কথা শুনে খুশি হয়ে চন্ডালরূপী অগ্নিদেব তার গৃহে ভোজন গ্রহণ করলেন এরপর অগ্নিদেব তার ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করে নিজ মূর্তি ধারণ করলেন ও ব্রাহ্মণ দানরুচিকে যোগেশ্বর নাম দান করলেন। পরে সেই ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ পত্নী উভয়েই মোক্ষপদ প্রাপ্ত হলেন। এই কাহিনি শেষ করে শিব পার্বতীকে বললেন হে গিরি রাজনন্দিনী তোমার কাছে যে ব্রাহ্মণ মাহাত্ম্য কীর্তন করলাম তা কেউ নিয়মিত পাঠ বা শ্রবণ করলে পবিত্র সুখ ও অভীষ্ঠ ফল লাভ করবে।"

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...