সনাতন ধর্মের পাঁচটি ভাগ, বৈষ্ণব , শৈব, শাক্ত, গাণপত্য, সৌর। ভগবান বিষ্ণুর একনিষ্ঠ উপাসকদের বলা হয় বৈষ্ণব, অন্যদিকে শক্তির আরাধনা করেন যারা তারা শাক্ত আর গণেশের আরাধনা করেন যারা তারা গাণপত্য। যারা সূর্যের আরাধনা করেন তাদের সৌর বলা হয় আর শিব ভক্তরা শৈব সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। শিব পুরাণ মূলত শৈবধর্মের গ্রন্থ। এখানে সর্বত্র শিবেরই জয়জয়কার। দেবাদিদেব মহাদেবের মাহাত্ম্য কথায় এখানে প্রতিষ্ঠিত। কীভাবে মহাদেবের কৃপা লাভ করা যায়, দেবাদিদেবের বিভিন্ন লিঙ্গের উৎপত্তি কথা ও দেবাদিদেবের মাহাত্ম্য সূচক কথা এখানে বলা হয়েছে।
এই পুরাণের বায়বীয় সংহিতার পূর্বভাগের প্রথম অধ্যায়ে বলা হয়েছে কীভাবে মহাদেবের কৃপায় শ্রীকৃষ্ণ পুত্রলাভ করেছেন। নৈমিষারণ্যে যেসকল ঋষিগণ বাস করেন তারা বায়ু দেবের কাছ থেকে কিছু তত্ত্ব কথা শুনবার জন্য ভক্তি ও শ্রদ্ধা সহকারে বসেছিলেন। এমন সময় বায়ু দেব সেখানে এসে নির্দিষ্ট আসন গ্রহণ করলেন। বায়ু দেব মুনিদের বললেন, "আমি সেই অপরাজিত মহাদেবকে ভজনা করি। এই সমুদয় বিশ্বচরাচর তারই বিভূতি।" এই কথা শোনামাত্রই ঋষিদের পাপক্ষয় হল! তখন তারা মহাদেবের সেই বিভূতিকে জানার জন্য বায়ু দেবকে প্রশ্ন করলেন।
বায়ুদেবের কাছে ঋষিরা বললেন, আমরা শুনেছি বসুদেব পুত্র শ্রীকৃষ্ণ মুনিবর উপমন্যুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পাশুপত ব্রতের অনুষ্ঠান করেন তাতে তার পরম জ্ঞান লাভ হয় এখন আমরা এই কথা জানতে চাই যে, কৃষ্ণ কীরূপে সেই পরম জ্ঞান লাভ করেছিলেন?
বায়ু বললেন বসুদেব পুত্র শ্রীকৃষ্ণ ভগবানের অবতার হয়ে মনুষ্যরূপে জন্মগ্রহণ করেন ও এক সময় তিনি মহাশক্তিধর মুনি উপমন্যুর নিকট গমন করেন। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেন উপমন্যুর মস্তকে জটাধর, সর্বাঙ্গ রুদ্রাক্ষমালায় ভূষিত। তার শিষ্যগণ তাকে ঘিরে রেখেছিল এবং উপমন্যু একাগ্রভাবে শিবের ধ্যানে রত ছিলেন তার মুখমন্ডল থেকে জ্যোতি নির্গত হচ্ছিল। কৃষ্ণ তাকে এইরূপে দর্শন করে রোমাঞ্চিত হয়ে নমস্কার করেন এবং তাকে তিনবার প্রদক্ষিণ করেন। মুনিবর উপমন্যু কৃষ্ণকে পাপ শূণ্য দেখে 'অগ্নি' ইত্যাদি মন্ত্র উচ্চারণ করে তার গায়ে ভস্ম লেপন করে দেন এবং সেই মুনি উপমন্যু দ্বাদশ মাসব্যাপী পাশুপত ব্রতের অনুষ্ঠান করে পাশুপত জ্ঞান দান করেন।
সেই দিন থেকে পাশুপতধর্মী মুনিগণ কৃষ্ণকে চারিদিকে ঘিরে উপাসনা করতে লাগলেন তারপর কৃষ্ণ গুরু উপমন্যুর আজ্ঞা মেনে পার্বতী সহ দেবাদিদেব মহাদেবের উদ্দেশে পুত্র কামনায় তপস্যা করলেন। সেই তপস্যার প্রভাবে এক বছর পর শ্রীকৃষ্ণ পার্বতীসহ মহাদেবের দর্শন লাভ করলেন এবং মহাদেব ও পার্বতী তাকে পুত্র লাভ করার বর দিলেন। যেহেতু মহাদেব ও পার্বতী সহ কৃষ্ণকে পুত্র লাভের বরদান করেছিলেন সেই কারণে কৃষ্ণ জাম্ববতীর গর্ভজাত তার প্রথম পুত্রের নাম রাখলেন শাম্ব।
এরপর মুনিগণকে বায়ুদেব পুরাণ সমূহ সম্পর্কে বলতে শুরু করলেন, বায়ুদেব বললেন, “পুরাণ সকলের সংখ্যা অষ্টাদশ। এই অষ্টাদশ পুরাণের নাম হল ব্রহ্মপুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ, শিব পুরাণ, পদ্মপুরাণ, ভাগবত, ভবিষ্য পুরাণ, বৃহন্নারদীয় পুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, অগ্নিপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, লিঙ্গ পুরাণ বরাহ পুরাণ, স্কন্দপুরাণ, বামন পুরাণ , কূর্ম পুরাণ, মৎস্য পুরাণ, গরুড় পুরাণ এবং ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ। অষ্টাদশ পুরাণের মধ্যে তৃতীয় শিব পুরাণ। এই পুরাণে শিবের মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। এই ভগবান শিব দ্বারা গঠিত এই মূল গ্রন্থটি দেবলোকে অবস্থিত। একমাত্র শিব ভক্ত ও ধর্ম পরায়ন শিষ্যদের এই কথা বলবে। এই পুরাণকথা পাঠ বা ভক্তি সহকারে শ্রবণ করলে মানুষ ইহকালে মুক্তি লাভ করতে পারে। তার সকল পাপ নিঃশেষে ক্ষয় হয়।"
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই অধ্যায় পাঠের পরে কিছু প্রশ্ন সৃষ্টি হবে, বৈষ্ণব ধর্মালম্বীদের মনে। কারণ তারা জানেন শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান, কিন্তু শৈব পুরাণে বলা হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণ শৈব, তিনি শিবের ভক্ত। আবার একই ভাবে শৈব পুরাণে শিবকে ভগবান বলা হয় আর বিষ্ণুপুরাণে বলা হয় শিব হলেন পরম বৈষ্ণব, ভগবান বিষ্ণুর একনিষ্ঠ ভক্ত। তাই রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের 'যত মত তত পথ' অনুসারে বলা যায় প্রতিটি কথাই সত্য, আলাদা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গির থেকে। দেবাদিদেব মহাদেব যেমন শ্রীকৃষ্ণের মাহাত্ম্য বোঝানোর জন্য রাসলীলায় ছদ্মবেশে অংশগ্রহণ করেছিলেন তেমনই ভগবান শ্রীকৃষ্ণও স্বয়ং ভগবান হয়েও দেবাদিদেবের কৃপা প্রার্থনা করেছিলেন দেবাদিদেবের মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য-আবার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এক জায়গায় বলেছেন আমি অপেক্ষা আমার ভক্ত বড়! ভক্তের চরণ ধরলেই আমাকে পাবে। তাই ভক্তের মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য ভগবান কত কিছুই না করে থাকেন নিজে ছোট হয়ে ভক্তকে শ্রেষ্ঠ আসন দেন। এমনটা বুঝতে পারলেই আর ধর্মে ধর্মে কোন ভেদাভেদ থাকে না এবং ভগবানের লীলারস আস্বাদন করা যায়।