বাঁদরামি করলে খাবে বাঁদর-চড়!
আদরে বানর হওয়ার কোনও চান্সই দেয় না মায়ের হাতের বিরাশি সিক্কা । শিব ঠাকুরের আপন দেশে এতো ঘর ঘর কি কাহানি। ‘পেরেন্টিং’র মাস্টার ক্লাস, ম্যানুয়াল লাগে কিচ্ছু লাগে না, ওষুধ একটাই- মায়ের বানর চড়। খান কতকে সিধে হয়ে যায় সব বেয়াড়ার দল।
ছাদের শেকল খুলে, জানলার গরাদ গলে, রান্নাঘর থেকে পড়ার ঘর সব জায়গায় ঢুকে পড়েছেন তিনি। দড়ির মতো লম্বা লেজ, মিটমিটে চোখ, চটপটে বুদ্ধি আর হুপহুপে কবেই দখল করে নিয়েছেন মসনদ। তাঁর সঙ্গে পাল্লা দেওয়া চাট্টিখানি কথা নাকি!
তাই সীতা উদ্ধারে তাদেরই সাহায্য নিয়েছিলেন সীতাপতি। বানর সেনার দ্বারা গড়ে উঠেছিল রামসেতু। এছাড়া আছে রামের একনিষ্ঠ ভক্ত হনুমান। তেত্রিশ কোটি ভারতীয় ভগবানের অন্যতম। রামায়ণের যুগ থেকে মহাভারতের যুগে তাঁর অবাধ বিচরণ।
তবে যাদের দেখলেই আমরা আয়না দেখাই, ‘এই হনুমান কলা খাবি’ বলে লাফালাফি শুরু করে দিই রামের বানর সেনা কিন্তু তারা নয়। রামায়নের অন্যতম চরিত্র সুগ্রীব আর বালি, পুরাণে তাদের অন্যরকম ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। হনুমানের জন্ম নিয়েও পুরাণে একাধিক কাহিনি পাওয়া যায়। আবার দেবশিল্পী বিশ্বকর্মাও বানর জন্ম নিয়েছিলেন। এমনি কি একটি কাহিনি বলে মহাদেবকেও বানর কুলে জন্ম নিতে হয়েছিল একবার।
বাল্মীকি তাঁর রচিত রামায়ণে ১০৮০ বার ‘বানর’ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন। ৪২০ বার বানরদের ‘কপি’ সম্বোধন করেছেন। বানরদের ‘হরি’ সম্বোধন করা হয়েছে ৫৪০ বার।
তবে সে সব স্ট্যাটিসটিক্সের কথা। আমাদের রোজকার জীবনে চলার জন্য তিনটে গাইড দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তাদের একজনের চোখ হাত দিয়ে বাঁধা। আরেক জনের কান দু’হাত দিয়ে ঢাকা। আর জন দু’হাতেই প্রাণপনে চেপে আছে মুখ। গান্ধীজীর তিন বাঁদর। বুরা মাত বোলো। বুরা মাত শুনো। বুরা মাত বলো।
তিন বাঁদরের নাম মিজারু, কিকাজারু ও ইয়াজারু। মিজারু, যে তার চোখ বুঝে আছে খারাপ কিছু দেখবে না বলে। কিকাজারুর কান ঢেকে রেখেছে খারাপ কথা শুনবে না বলে। আইওয়াজারু তার মুখ চেপে রেখেছে কোনও খারাপ কথা বলবে না বলে।
পাশাপাশি চুপচাপ বসে থাকে তারা তিনজন। আর সারাক্ষণ বুঝিয়ে যায় কী সাংঘাতিক কঠিন কাজটাই না করে চলেছে তারা সারাক্ষণ!
এই তিন বানরের ধারণা এসেছে জাপান থেকে। ‘মিজারু’, ‘কিকাজারু’ আর ‘আইওয়াজারু’ নাম তিনতিও জাপানেই প্রচলিত। জাপানের বাইরে এই তিন জ্ঞানী বানরের নাম মিজারু, মিকাজারু ও মাজারু।
জ্ঞানের প্রতীক হিসেবে জনপ্রিয়। তিন বানরকে বলা হয় ‘দ্য থ্রি ওয়াইজ মাংকিজ’।
জ্ঞানী বানরের সঠিক উৎস সম্পর্কে বিশদে জানা যায়। সপ্তম শতাব্দীতে বৌদ্ধ দর্শনে এই প্রতীকের প্রথম প্রকাশ। জুয়ানজ্যাং নামে এক সন্ন্যাসী তাঁর লেখায় ব্যবহার করেছিলেন। বৌদ্ধ ধর্ম গ্রন্থের অনুবাদক ছিলেন তিনি। তিন বানরের উল্লেখ পাওয়া যায় কনফুসিয়াসের লেখাতেও। অনেকের মতে, জাপানের কোশিন মতবাদ থেকে এদের উৎপত্তি। কোশিন মতবাদ অনুসারে, মানব দেহে তিনটি পোকা বা কীট বাস করে, যারা ‘সানসি’ নামে পরিচিত। এই কীটগুলো মানুষের সকল ভালো ও খারাপ কাজের হিসাব রাখে। প্রতি ৬০ দিন অন্তর অন্তর এরা মানব শরীর ত্যাগ করে এবং ‘টিন-টেই’ নামক দেবতার কাছে মানুষের এই ভালো-খারাপ কাজের হিসাব পৌঁছে দেয়। কোশিন মতবাদ অনুসারে, এই তিন বানর ‘সানসি’ ও ‘টিন-টেই’কে মানুষের খারাপ কাজ দেখতে, শুনতে ও বলতে বাধা দেয়। এছাড়া এই তিন বানরের সচিত্র রূপ সর্বপ্রথম দেখা যায় জাপানের নিক্কোতে অবস্থিত বিখ্যাত ‘তোসুগু’ মঠে। এই তিন বানর টেণ্ডাই দর্শনের তিনটি মতবাদকে প্রকাশ করে।
বানর নিয়ে নানা দর্শন আর উপকথার শেষ নেই। মানবেতর প্রাণী হলেও বানর থেকেই মানুষের বিবর্তন। তাই এরা দুরন্তভাবে নকল করতে পারে মানুষের যে কোনও আচরণকে।
২০০০ সাল থেকে ১৪ ডিসেম্বর দিনটি বিশ্বজুড়ে পালিত হয় বানর দিবস হিসেবে। এই প্রাণীটি সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলাই দিনটি উদযাপনের উদ্দ্যেশ্য। ২০০০ সালে বিতর্কিত শিল্পী কেসি সরো এবং এরিক মিলিকন যখন মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিল্পকলার ছাত্র ছিলেন তখন তাঁরা দিনটির সূচনা করেন। এটি ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব উৎসব। পরে পরিবেশবিদদের দৌলতে দিনটি হয় ওঠে বিশ্বজুড়ে বানর দিবস।