অমৃত উদ্ধার নিয়ে ধুন্ধুমার চলছে প্রবল কাড়াকাড়ি। সমুদ্র তোলপাড় করে অমৃত তুলে আনতে গিয়ে উঠে এসেছিল বিষাক্ত হলাহল। সেই বিষ কণ্ঠে ধারণ করে নীলকণ্ঠ হয়েছিলেন শিব।
মন্দার পর্বত মন্থনের ফলে পর্বতবাসী জীব, জন্তু, পাখি, গাছগাছালি সব মারা পড়ে। মৃত্যু হয় জলবাসী প্রাণীদেরও। একসময় নোনা জ লের সমুদ্র হয়ে ওঠে দুধের সাগর। তার তল থেকে একে একে উঠে আসে চাঁদ, লক্ষ্মী, ধন্বন্তরি।
সমুদ্র মন্থন কালে যে তিথিতে লক্ষ্মী আবির্ভূত হয়েছিলেন সেই তিথিটি ছিল কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী। সেই সূত্রেই এই তিথি সাধারণের মধ্যে ধন ত্রয়োদশী তিথি নামে পরিচিত। ধন্বন্তরি তিথি নামেও পরিচিত।
রাজস্থানীদের উচ্চারণে ‘ধনতেরস’। এই ‘ধনে’ লক্ষ্মী আছেন। তিনি সমৃদ্ধি, শ্রী, পুষ্টি, মেধা, ধরা, তুষ্টি ও প্রভামতী। লক্ষ্মীর নয়টি শক্তির আধার। বিভূতি, উন্নতি, কান্তি, হৃষ্টি, কীর্তি, সন্নতি, ব্যুষ্টি, উৎকৃষ্টি ও ঋদ্ধি।
ধনতেরসের দিন লক্ষ্মীর সঙ্গে পূজিত হন ধন্বন্তরি দেবও। তিনি আয়ুর্বেদের দেবতা। তাঁর উপাসনায় রঅগ-মারী থেকে রক্ষা পায় মানুষ। অনেক জায়গায় এই দিনটিকে বলা হয় বসুবর্ষ বা বসুবরস। বসু বরস থেকে শুরু হইয় দীপাবলি উৎসব। ‘বসু’ অর্থে ধন, রত্ন, বৃদ্ধৌষধি, সোনা, জল, গাছ, আগুন, সূর্য। এই দিনে সবৎস গো পুজোর প্রচলন আছে। বৈদিক যুগে গো ছিল সম্পদ আবার দেবতাও।
ধনতেরসের দিন ঘরে ঘরে ধনলক্ষ্মীর পুজো হয়। অশুভকে দূর করে যাতে শুভর আগমন হয় তার জন্য দীপমালায় সাজানো হয় ঘর। সারা রাত ঘরে আলো জ্বলে সম্পদের দেবী আর স্বাস্থ্যের দেবতার জন্য।
ধনতেরস বা ধন ত্রয়োদশীর মহিমা নিয়ে একটি পুরাণ গল্পও প্রচলিত আছে। এই কাহিনি ভীষণভাবে মিলে যায় বাংলার মনসামঙ্গলে বলা বেহুলা-লখীন্দরের কাহিনির সঙ্গে।
হেমনক নামে এক রাজা ছিলেন। অনেকে আবার হিমও বলত তাঁকে। সেই রাজার এক ছেলে ছিল। জন্মের পর ছেলের কোষ্ঠী বিচার করে পন্ডিত বলেন- রাজপুত্র তার বিয়ের চতুর্থ রাতে সাপের কামড়ে মারা যবেন।
এদিকে ছেলে বড় হচ্ছে। সে বিয়ের বয়সে পৌঁছে গিয়েছে, কিন্তু ছেলের বিয়ের কথা ভাবলেও মৃত্যুযোগ আতঙ্কগ্রস্থ করে তোলে রাজাকে। শেষপর্যন্ত রাজপুত্রের বিয়ের জন্য কন্যা স্থির করলেন রাজা। বিয়ের আগে মেয়ের বাড়িতে রাজ জ্যোতিষীর কথা জানিয়েই ছেলের বিয়ে দিলেন।
বিয়ের চতুর্থ রাতে ঘরে সারারাত জেগে থাকল নতুন বউ। রাজপুত্রকেও সে ঘুমতে দিল না। যতবারই স্বামীর ঘুম আসে ততবারই সে জাগিয়ে দেয়। ঘরের সামনে সমস্ত গহন, ধনরত্ন, গিনি মোহর স্তূপ করে রেখে চারদিকে প্রদীপ জ্বালিয়ে দিল। সোনা-হীরে-মানিক-রত্নের গায়ে আলো পড়ে ধাঁধিয়ে উঠল চারপাশ।
অনেক রাতে রাজপুরী একেবারে নিঝুম হয়ে যেতে সাপের বেশে হানা দিল যম। দরজায় আসতে না সতেই হীরে জহরতের গা থেকে ঠিকরে আসা আলোয় চোখ গেল ঝলসে। যম আর ঘরে প্রবেশ করতে পারলেন না। অপেক্ষা করতে লাগলেন দ্বারেই। সোনার স্তূপের ওপারেই রাজপুত্র আর তার স্ত্রী। তারা গান গাইছে। এভাবেই রাত পার। যমেরও অধীন নয় যে সময়। সময়ের কাঁটা পেরিয়ে যেতে বিদায় নিত হল যমকে। প্রাণ বেঁচে গেল রাজপুত্রের। বুদ্ধির বলের জন্য যুবরানীকে ধন্য ধন্য করল রাজ্যবাসী। সেই থেকে লোকবিশ্বাস কার্তিক ত্রয়োদশীর সন্ধ্যেয় যমের উদ্দ্যেশ্যে প্রদীপ দিলে যম ভয় থাকে না। পদ্ম পুরাণ এবং স্কন্দপুরাণেও উল্লেখ আছে।
স্কন্দপুরাণ মতে, ত্রয়োদশি তিথিতে শুদ্ধাচারে গোবর্ধন দেবের পুজো করতে হবে। সন্ধ্যেয় যমের উদ্দ্যেশে দীপাবলি পালন।
ধনতেরাসের সূচনা হয় কার্তিক মাসের কৃষ্ণা একাদশীর দিন। পাঁচ দিন ধরে চলে। এই পাঁচদিন রাত্রের পূর্বার্ধে দেবতা, ব্রাহ্মণ, হাতি, ঘোড়া এবং শ্রেষ্ঠদের পূজা ও আরতি করা হয়। যে প্রদীপ দিয়ে আরতি হবে সেই প্রদীপের যথাযথ সংরক্ষণ জরুরী।
পুরাণে প্রদীপের নানা লক্ষণের কথা বলা হয়েছে। দীপ রাখার পর তার শিখা যদি রুক্ষ হয় তাহলে সম্পদ ক্ষয় হয়। সাদা হলে অন্নকষ্ট। অতি রুক্ষে যুদ্ধ এবং কাল শিখায় মৃত্যু। প্রদীপের শিখা উজ্জ্বল ও স্নিগ্ধ হলে তা গৃহস্থের জন্য মঙ্গলজনক।