'রাধাতন্ত্র'-এ বলা হয়েছে, সতীর কেশ পড়েছিল যে-স্থানে, সেই পীঠস্থানেই একদা গড়ে উঠেছিল, 'বৃন্দাবন'। 'বৃন্দাবন' ঘিরে বারোটি বন--'ভদ্র বন', 'শ্রীবন', 'লৌহ বন', 'ভান্ডীর বন', 'মহাবন', 'তালবন', 'খদির বন', 'বহুবন', 'কুমুদবন', 'কাম্যবন', 'মধুবন' ও 'বৃন্দাবন'। এছাড়া কিছু উপবনও আছে। তার মধ্যে 'নন্দন' ও 'আনন্দ' বনে কৃষ্ণ শয়ন করেন। 'পলাশ', 'অশোক' ও 'কেতকি' বনে কৃষ্ণ গন্ধসুখ উপভোগ করেন, 'কৌলবন'-এ অমৃত আস্বাদন করেন। 'সঙ্কেত', 'দ্বিপদ', 'চতুর্থ বন'- প্রভৃতি বনে কৃষ্ণ রাসলীলা করেন, আমোদ করেন। অন্যান্য বনে গোচারণ করেন।
সংস্কৃত পুরাণ থেকে চোদ্দ শতকে লেখা চণ্ডীদাসের বাংলা কাব্য 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন'--কোথাও কিন্তু রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে 'কামগন্ধহীন প্রেম'- বলে তুলে ধরার চেষ্টা হয়নি। পরবর্তীকালে চৈতন্যপূর্ব পদাবলীযুগের বৈষ্ণব মানসে এই প্রেম 'কামগন্ধহীন-লীলা' হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা হল, তত্ত্ব প্রচারিত হল। কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর 'চৈতন্য চরিতামৃত'-এ লিখলেন :
"আত্মেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা তারে বলে কাম।
কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম।।"
একমাত্র এই তত্ত্ব ধরে এগোলেই ঝুলনের আধ্যাত্মিক তাৎপর্য আমরা বুঝতে পারব, নইলে সেটা নেহাৎ স্থূল হয়ে যায়।
ভাগবত মতে, পদ্মিনী লক্ষ্মী দুই আধারে জন্ম নিয়েছিলেন। এক স্বয়ং রাধা আর অন্য রূপটি হল রাধার প্রিয় সখী চন্দ্রাবলী। কোথাও এঁরা আবার অভিন্ন, একজনেরই দুই নাম। কৃষ্ণের প্রেম কে জয় করে নিতে পারেন--এই নিয়ে এঁদের মধ্যে সুপ্ত প্রতিযোগিতাও ছিল। তবে, রাধার মতো ভক্তপ্রেমিকা আর কেউ ছিলেন না। কৃষ্ণই ছিলেন তাঁর ধ্যান, কৃষ্ণই ছিলেন তাঁর জ্ঞান। তবু, কৃষ্ণের 'হ্লাদিনী' হয়ে ওঠায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল রাধার 'অহং' অর্থাৎ 'আমিত্ব'। সেই জন্যই তো চন্দ্রাবলীর সঙ্গে তাঁর প্রতিযোগিতা। ‘আমি’র বেড়া না-থাকলে প্রতিযোগিতা হয় না। সেই বেড়া ভাঙতেই কৃষ্ণ আয়োজন করেছিলেন ঝুলনলীলার।
শ্রাবণমাসের পূর্ণিমা তিথির ঘোর বর্ষায় যখন প্রাকৃত-প্রাণীরা প্রেমলীলায় মত্ত হয়; তখন আয়োজন হল, রাধাকৃষ্ণের ঝুলনলীলার। সঙ্কেত বনের ধারে যমুনার তীরে যে কদম গাছটি ফুলে ফুলে ভরে উঠেছিল তার ডালে দোলনা বাঁধা হল। দোলনা সাজানো হল নানা রঙের ফুল দিয়ে। এমনকি, কৃষ্ণ-গোপিনীরাও ফুলে-মালায় সেজে উঠলেন। ফুলমালায় সেজে সেখানে রাধারও আসার কথা। কিন্তু, শাশুড়ি-ননদের প্রহরা পেরিয়ে আসতে রাধার খানিক দেরি হল। পথে তিনি ভাবতে ভাবতে আসছিলেন যে, কৃষ্ণ নিশ্চয়ই তাঁর জন্য উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু, এসে দেখলেন কোথায় কী! কৃষ্ণ এরই মধ্যে গোপিনীদের সঙ্গে মেতে উঠেছেন ঝুলন খেলায়! তাই দেখে বড় অভিমান হল তাঁর। 'আমার চেয়ে তারা বড় হল! তাদের প্রেম কি আমার চেয়েও বড়? আমাকে উপেক্ষা করলেন কৃষ্ণ! আমাকে?'--এভাবেই বেরিয়ে এলো ‘আমি’র অহং। বুকফাটা অভিমান কান্না হয়ে নেমে এলো চোখ বেয়ে। ঠিক তখনই কৃষ্ণ তাঁর কাছে এলেন, চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে ধীরে ধীরে বুঝিয়ে দিলেন, রাধার এই যে অভিমান, এর কারণ আসলে ‘আমির আবরণ’। অন্তরে কৃষ্ণকে বসিয়েও রাধা তাই তাঁকে যেন পুরোপুরি পেয়েও পাচ্ছেন না। এই যে দেহটা এর মধ্যেই কি শুধু রাধা আছেন? তা তো না। তিনি তো সমস্ত চরাচরে, সমস্ত প্রকৃতি জুড়ে রয়েছেন, এমনকি এই যে গোপিনীরা, এঁদের মধ্যেও রয়েছেন। রাধা বিরহের বেলায় কালো মেঘের মধ্যে যেমন শ্যামকে দেখেন, তেমনি কৃষ্ণও পুরুষ হয়ে সমস্ত প্রকৃতির মধ্যে রাধাকে খোঁজেন। তখন রাধা তাঁর ভুল বুঝতে পারলেন। এসে বসলেন দোলনায়, প্রিয় কৃষ্ণের পাশে। গোপিনীরা দোলনায় দোল দিতে লাগলেন পরম আনন্দে। ‘আমি’র অহং চূর্ণ হয়ে মিলন হল বাইরের রাধার সঙ্গে অন্তরের কৃষ্ণের। পূর্ণরূপে ইষ্টকে পাবার তখন আর কোন বাধা রইল না। এই পথে অহং-এর আবরণ খুলে নিরাবরণ-প্রকৃতি হয়ে চৈতন্যদেব ও রামকৃষ্ণদেব রাধাভাবে ইষ্টের সাধনা করেছেন, ইষ্টকে পেয়েওছেন। আসলে, এই পথ দেখানোতেই ঝুলন লীলার সার্থকতা। কেননা, পথ পেলে তবেই সাধনা তার লক্ষ্য খুঁজে পায়।