কৃষ্ণ মানেই মোহন বাঁশির সুর। কানে এলেই মিথ্যে হয়ে যায় দুনিয়া। সন্মোহিত করে শ্যামের বাঁশি। নিয়ে যায় অন্য ভুবনে। এই সুরে কেবল রাধা নয় মেতেছিল গোটা জগৎ সংসার। বাঁশি আর কৃষ্ণ তাই সমার্থক। শ্রী কৃষ্ণের বাঁশি তাঁর অঙ্গ। তাই তিনি মোহনবংশীধারী।
বৃন্দাবনের কদমতলীতে কৃষ্ণের সুর ছড়িয়ে পড়ত বৃন্দাবনের পথে ঘাটে। যমুনার জলে। আয়ান ঘোষের অন্দরমহলে। আনমনা হতেন রাই বিনোদিনী। মধুর মুরলী ধ্বনি আর শ্যাম একাকার তাঁর কাছে।
তিন ধরনের বাঁশি বাজাতেন কৃষ্ণ। একটির নাম বেণু, অন্য অন্যটি মুরলী এবং তৃতীয়টি বংশী।
বেণু অত্যন্ত ছোট আকারের। দৈর্ঘ্যে ছয় ইঞ্চি, তাতে ছয়টি ছিদ্র। মুরলীর দৈর্ঘ্য প্রায় আঠারো ইঞ্চি। তার একপ্রান্তে একটি ছিদ্র, তার গায়ে চারটি ছিদ্র। বংশী প্রায় পনেরো ইঞ্চি লম্বা। নয়টি ছিদ্র তাতে। শ্রীকৃষ্ণ প্রয়োজন অনুসারে এই তিন রকমের বাঁশী বাজাতেন। শ্রীকৃষ্ণের আর একটি বংশী আছে। লম্বা এই বাঁশির নাম মহানন্দ বা সম্মোহনী। মহানন্দের থেকে দীর্ঘ বাঁশিকে বলা হয় আকর্ষণী। তার চেয়েও দীর্ঘ 'আনন্দিনী’। আনন্দিনীর সুর গোপ বালকদের অত্যন্ত প্রিয়। এই বাঁশির অপর নাম বংশুলী।
শ্রীকৃষ্ণ কীভাবে বাঁশি পেয়েছিলেন?
এ সম্পর্কে একাধিন পুরাণ কাহিনি প্রচলিত আছে। একটি কাহিনি বলে, শ্রীকৃষ্ণকে এই বাঁশি দিয়েছিলেন স্বয়ং মহাদেব। দ্বাপর যুগে যখন কৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেন তখন সমস্ত দেব দেবতারা উপহার নিয়ে তাঁকে দর্শন করেছিলেন। ভগবান শিব দিয়েছিলেন মহর্ষি দধীচির শরীরের হাড় দিয়ে তৈরি বাঁশিখানি। তারপর থেকেই বাঁশি হয়ে ওঠে শ্রীকৃষ্ণের অতি প্রিয়।
অন্য কাহিনিটিও শ্রীকৃষ্ণের বাল্যলীলারই অন্তর্গত। সেই কাহিনিটি এরকম,
বালক কৃষ্ণ একদিন খেলা করতে করতে একদিন গঙ্গার তীরে গিয়েছিলেন। দেখলেন একজন বৃদ্ধ বাঁশি বাজাচ্ছেন। তিনি বাঁশি বিক্রিও করছিলেন। ওই বাঁশির সুর শুনে শ্রীকৃষ্ণ বৃদ্ধ লোকটির কাছে যান এবং বলেন, হে মুনিবর আপনার বাঁশির সুর খুব সুন্দর। আপনি কি আমাকে বাঁশি বাজানো শিখিয়ে দিন। তখন বৃদ্ধ লোকটি বললেন, ‘তুমি খুব ছোট।। তুমি পারবে না বাঁশি বাজাতে’।
একথা শুনে বালক শ্রীকৃষ্ণ কেঁদে ফেললেন। তিনি বারবার অনুরোধ করছিলেন বাঁশি বিক্রেতাকে সুর শেখানোর জন্য।
শেষে বৃদ্ধের খুব দয়া হল। তিনি রাজী হলেন বাঁশি বাজানো শেখাতে। শ্রীকৃষ্ণ খুবই আনন্দিত হলেন। বৃদ্ধ লোকটি শ্রীকৃষ্ণ এর হাতে একটি বাঁশি দিলেন এবং বললেন, আমি যেভাবে বাজাবো তুমিও ঠিক সেইভাবে বাঁশি বাজাবে। শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ‘ঠিক আছে’।
বৃদ্ধ যেভাবে শেখালেন ঠিক সেভাবেই শ্রীকৃষ্ণ বাঁশিতে সুর তুললেন। সেই সুর শুনে ত্রিলোক মোহিত হয়ে গেল। দেবদেবীরা পুষ্প বৃষ্টি করতে লাগল দিকে দিকে। তখন বৃদ্ধ বাঁশিওয়ালা ভাবলেন, এ কোন সাধারন বালক নয়।। শ্রীকৃষ্ণ বাঁশি বাজাচ্ছিলেন, সেই সময় বৃদ্ধ লোকটি তার চরনে আশ্রয় নিলেন।
শ্রীকৃষ্ণের বাঁশিতে শুধু মাত্র রাধারানীই পাগলিনী ছিলেন না। ব্রজ ভূমি থেকে শুরু করে, পশু পাখি কীটপতঙ্গ তথা সকল গ্রামবাসী বিভোর থাকতেন এই সুরে।
নানা কাহিনি আছে বাঁশি নিয়ে। কৃষ্ণের বাঁশির সুর রাধারানী ও গোপিনীরা মেতে থাকলেও হিংসে করতেন তাঁরা শ্যামের বাঁশিকে।
কৃষ্ণ সারাক্ষণ বংশীতে মেতে থাকতেন বলে একবার তাঁরা খুব রুষ্ট হন কৃষ্ণের ওপর। তাঁরা মনে করতেন যত নষ্টের গোড়া ওই বাঁশি। কারণ, ও বাঁশির জন্যই তো কৃষ্ণ তাঁদের দিকে মন দেন না! সেজন্য সকলে মিলে ঠিক ক লেন বাঁশি চুরি করে ভেঙে ফেলব্যাং যাতে কৃষ্ণ আর বাঁশি নিয়ে ব্যস্ত থাকতে না পারেন। কিন্তু চুরি করবেন কীভাবে? বাঁশি তো সারাক্ষণ কৃষ্ণের সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে!
শ্রীকৃষ্ণ গোপীদের মনের ইচ্ছা বুঝতে পেরে বাঁশিটিকে নিজের থেকে দূরে রেখে অন্যদিকে মনোনিবেশ করলেন। তাঁরা ভাবল কৃষ্ণ বুঝি অসতর্ক, বাঁশির প্রতি কোনও ধ্যানই নেই! সেই সুযোগে চুপি চুপি বাঁশিটিকে তাঁরা চুরি করলেন।
গোপীদের মনের উৎফুল্লতা দেখে শ্রীকৃষ্ণের হৃদয়ে আনন্দের সঞ্চার করল, তার বহিঃপ্রকাশ ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল। ভগবান এমনই করুনাময়! এমনই ভক্তপ্রেমী! ভক্তের আনন্দে যেমন প্রসন্ন হন, ভক্তের কষ্টে উদ্বেলিত হন! ভক্তের মনবাঞ্ছা ঠিক পূরণ করেন।
গোপীরা ভাব্লেন তাঁদের প্রথম কাজটি সফল হয়েছে যখন, তখন দ্বিতীয় কাজটি সেরে ফেলতে হবে! যে না বাঁশিটিকে ভাঙতে যাবে বাঁশি আর্তনাদ করে উঠল! সে বলল, “এভাবে আমাকে আপনারা কৃষ্ণের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত করলেন কেন?”
গোপীরা হতবাক হয়ে বললেন : “তুমিই আমাদের কষ্টের কারন, তুমিই আমাদের হতাশার কারন। তোমার এমন কি গুণ আছে যে, তুমি সর্বদা কৃষ্ণের হাতে হাতে ফের আর তাঁর অধর স্পর্শ, তাঁর সান্নিধ্য উপভোগ করে থাকো?”
বাঁশি গোপীদের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মৃদু হেসে বলল, “গুণের কথা ছেড়ে দিন, আমার তো কোন অস্তিত্ব নেই। কারণ, আমার ভেতরে যে শাঁস ছিল তা ফেলে দেওয়া হয়েছে। ফলে আমার নিজস্ব কোন সত্ত্বাই এখন আর নেই। আমার গোটা শরীরটাই ফাঁপা। আমার আমিত্ব বলে আর কিছু নেই।
আমার যা কিছু সব কৃষ্ণের। আমার নিজের কোন সুরও নেই, ছন্দ নেই। কৃষ্ণের সুরই আমার সুর। তিনি যে ভাবে আমাকে বাজান, আমি সে ভাবেই বাজি। শরণাগত দীনার্তকে তিনি কখনও পরিত্যাগ করেন না। আমার সর্বস্ব তাঁকে অর্পণ করে আমি তাঁর আশ্রয় নিয়েছি। তাই তিনি আমাকে তাঁর অধরে রাখেন। আমি শুধু তাঁর হাতের যন্ত্র মাত্র। আমি যে আমিশূন্য।”
গোপীরা সেদিন বুঝেছিলেন বাঁশির মাহাত্ম্য। যখন বাঁশির মতো নিজের সর্বস্ব ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সমর্পন করতে পারলে তবেই ঈশ্বরের সান্নিধ্য পাওয়া যায়।
কৃষ্ণের বাঁশিতে থাকে মকর। সে নিয়েও আছে একটি কাহিনি।
একবার মা যশোদা ভুল করে একাদশীর দিন ভাত রান্না করেছিলেন। রান্নার পর মনে পড়ে একাদশীতে কেউ অন্নগ্রহণ করবেন না। চিন্তিত হয়ে মা যশোদা অন্ন নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন। মানুষ তো দূর কোনো পশু-পাখিও এই অন্নগ্রহণ করল না। ভারাক্রান্ত মনে একটি জলাশয়ের কাছে বসে থাকলেন। আর ভাবতে লাগলেন একাদশীতে ভাত রান্না করে খুব বড় ভুল করে ফেলেছেন। এমন সময় তিনি দেখতে পেলেন জলাশয়ের মধ্যে একটি মকর মাছ লাফালাফি করছে। তখন তিনি ভাবলেন একবার মকর মাছকে জিজ্ঞাসা করি। তারপর মা যশোদা মকর মাছকে বললেন, হে মকর মাছ আমি ভুল করে অন্ন রান্না করেছি। আজকের দিনে এই অন্ন ভক্ষণ মানে সহস্র পাপ ভক্ষণ করা। কিন্তু আমি নিরুপায়। কেউ গ্রহণ করতে চায় না। হে মকর মাছ তুমি কি গ্রহণ করবে? তখন মকর মাছ উত্তরে বলে, হ্যাঁ আমি ভক্ষণ করব তবে আমার একটি শর্ত আছে।
মা যশোদা জানতে চাইলেন কী সেই শর্ত। উত্তরে মকর মাছ জানায় একাদশী তিথিতে অন্ন ভক্ষণ করলে সহস্র পাপ হবে। আর সেই পাপ থেকে মুক্তি দেবে তোমার যাদু বাছাধন। কৃষ্ণের বাঁশি স্পর্শ করলে আমার সহস্র পাপ পুণ্যে পরিণত হবে। তুমি কি পারবে মা যশোদা গোপালের বাঁশিতে আমার স্থান দিতে? তাহলে আমি এই অন্ন গ্রহণ করব।
তখন মা যশোদা বললেন, তুমি এই অন্ন গ্রহণ করো। আমি কথা দিলাম গোলাপের বাঁশিতে তোমার স্থান হবে। মকর অন্ন গ্রহণ করল। মা যশোদা মকর নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের কাছে আসেন।
তিনি বললেন, একাদশী তিথিতে আমি অন্ন রান্না করে পাপের ভাগীদার হয়েছিলাম। এই মকর সেই অন্ন গ্রহণ করে আমাকে পাপমুক্ত করেছে। কিন্তু অন্ন গ্রহণের দায়ে সে সহস্র পাপের অধিকারী হয়েছে। তুমি এই মকর মাছকে তোমার বাঁশিতে স্থান দাও। আর মকর পাপমুক্ত কর’।
তখন শ্রীকৃষ্ণ বলেন, ‘আজ থেকে মকর মাছ সর্বদা আমার বাঁশিতে স্থান পাবে। যেখানেই কৃষ্ণের বাঁশি থাকবে সেখানেই মকর থাকবে। মকর ছাড়া কৃষ্ণের বাঁশি সম্পন্ন হবে না। আর এই কারণে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাঁশিতে সর্বদা মকর থাকে’।
কথিত আছে শ্রীকৃষ্ণ শেষ জীবনে এই বাঁশি ভেঙে ফেলেছিলেন। সারাজীবন তাঁর বিরহে আকুল ছিল রাধা, কিন্তু অন্তিমে রাধার বিরহে কাতর হয়েছিলেন কৃষ্ণ।
একটি কোল কাহিনি বলে, সারাজীবন কর্তব্যে অবিচল থেকেও কৃষ্ণ কখনও রাধাকে ভুলতে পারেননি। তাঁর তিন পত্নী ছিল কিন্তু রাধা তাঁর চিরদিনের। শেষ সময়ে রাধার সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন কৃষ্ণ। সেই সময় কৃষ্ণ রাধাকে কিছু প্রার্থনা করতে বলেন। রাধা তাঁর জীবনে শেষবারের মতো তাঁর বাঁশির সুর শুনতে চান। রাধার ইচ্ছেকে মর্যাদা দিয়েছিলেন তিনি।
রাধাকে তাঁর মোহন বাঁশির সুর শোনান। সেই সুরেই মৃত্যুর কোলে ঠাঁই নেন রাধা। শ্যামকে উপহার দেন অনন্ত বিরহ। তাপ-শো-বিরহে বাঁশি ভেঙে ফেলেছিলেন কৃষ্ণ। রাধাহীন জীবনে আর কোনও সুর ছিল না তাঁর।