শিব পুজোয় চাঁপা ফুল কেন বারণ?

শিব পুরাণের জ্ঞানসংহিতার পঞ্চদশ অধ্যায়ে চম্পক পুষ্পের প্রতি শাপদান বৃত্তান্ত রয়েছে। কী কারণে শিব পুজোয় অযোগ্য হিসেবে ঘোষিত হল চম্পক অর্থাৎ চাঁপা ফুল সেই কথায় সূত ঋষিদের নিকট ব্যক্ত করেছিলেন।

সূত বললেন, "কেতকীর শাপ কারণ আপনাদের কাছে বললাম। এইবার চম্পক পুষ্পের শাপ কারণ কথা আপনাদের বলছি।" এই বলে তিনি তার কথা শুরু করলেন-

গোকর্ণ দেশে ভগবান শম্ভু গোকর্নেশ নামে প্রসিদ্ধ হয়ে অবস্থান করছেন, সেখানে গিয়ে ভগবান শম্ভুকে দর্শন করলে সকল পাপ ভস্মসাৎ হয়ে যায়। একসময় দেবর্ষি নারদ ভগবান শম্ভুকে দর্শন করার জন্যই গোকর্ণ দেশে যাচ্ছিলেন পথে যেতে যেতে তিনি একটি জায়গায় সুগন্ধি চম্পক পুষ্প দেখতে পেলেন। ঠিক সেই সময় সেখানে ফুল তোলার জন্য একজন ব্রাহ্মণ এসে উপস্থিত হলেন।  সেই ব্রাহ্মণ ফুল তুলতে এলেও নারদকে দেখে ভাবলেন যে যদি তিনি এই মুহূর্তে ফুল তোলেন তাহলে এই ব্যক্তি তাকে নানান রকম কথা জিজ্ঞেস করবে এই ভেবে তিনি সেই মুহূর্তে ফুল না তুলে স্থির হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলেন। ব্রাহ্মণকে ফুলের সাজি হাতে দেখতে পেয়ে নারদ প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কেন এখানে এসেছ?’

ব্রাহ্মণ তখন সত্যি কথা না বলে উত্তর দিল, আমি ভিক্ষার জন্য যাচ্ছি। এরপর নারদ গোকর্ণ দেশে অবস্থিত শিব মন্দিরে গিয়ে ভগবান শিবকে প্রণাম করলেন ও তাঁকে তুষ্ট করে সেখান থেকে চলে গেলেন।

নারদ যখন মন্দির থেকে ফিরে আসছিলেন তখন‌ও তিনি সেই ব্রাহ্মণকে দেখলেন। সে ফুল তোলার কাজ শেষ করে ফুলের সাজিটিকে ঢেকে নিয়ে সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। এইবারও যখন নারদ তাকে জিজ্ঞেস করলেন যে সে কোথায় যাচ্ছে? ব্রাহ্মণ এইবারও মিথ্যে কথা বলল, যে সে ভিক্ষার জন্য যাচ্ছিল কিন্তু ভিক্ষা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে। এইবার নারদ চম্পক বৃক্ষের কাছে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, "হে পাদপ শ্রেষ্ঠ ওই ব্রাহ্মণ কোথায় গেল এবং কতগুলি পুষ্প চয়ন করল?"

ব্রাহ্মণ চম্পক বৃক্ষকে যথার্থ কথা বলতে নিষেধ করেছিল তাই চম্পক বৃক্ষ নারদকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কে? ব্রাহ্মণ কে? পুষ্প কে? কী জিজ্ঞেস করছ?”- এরপর নারদ  সমস্ত কিছু বুঝে শিবের কাছে গেলেন এবং সেখানে গিয়ে তিনি দেখলেন যে ১০০টি চম্পক পুষ্প শিবলিঙ্গের ওপর অর্পিত আছে।

নারদ তখন আরেক ব্রাহ্মণকে শিব পুজো করতে দেখে বললেন, “তুমি কে?  কী প্রার্থনা করছ?  কোন ব্যক্তি এইসব পুষ্প এনে শিবকে সমর্পন করেছে?”

 এই কথা শুনে ব্রাহ্মণ সত্য কথাই বললেন। তিনি বললেন যে, আমি ভগবান শিবকে পুজো দ্বারা মুক্তি প্রার্থনা করছি অপর এক ব্রাহ্মণ প্রতিদিন পুষ্প দ্বারা শিব পুজো করে রাজাকে মুগ্ধ করছে। সেই ব্রাহ্মণ এর জন্য রাজার কাছে প্রচুর অর্থ গ্রহণ করে বহু রাজার দান ও ক্ষমতা লাভ করে ধনমদে অন্ধ হয়ে আত্মীয় পর বিবেচনা করে না। তবে আমি ভগবান শিবকে পুজো করছি নিজের মুক্তির জন্য।

নারদ এই কথা শুনে প্রসন্ন হয়ে বললেন, তুমি অবশ্যই মুক্তি লাভ করবে এতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে ওই মিথ্যাবাদী ব্রাহ্মণ যে শিব পুজো দ্বারা রাজাকে বশীভূত করে অপর ব্রাহ্মণদের পীড়া দিচ্ছে তা কিন্তু সব‌ই হচ্ছে চম্পক পুষ্প থেকে। কারণ চম্পক পুষ্পে পূজিত হয়েই ভগবান শিব বশীভূত হয়েছেন।

এরপর নারদ শিবকে জিজ্ঞাসা করলেন, “ হে প্রভু আপনি কেন ব্রাহ্মণকে এই রূপ ফল দান করছেন?”

শিব তখন বললেন,  “এতে আমি কী করব?  তুমি তো জানো চম্পক পুষ্প থেকেই এইসব হচ্ছে। চম্পক পুষ্প দিয়ে পুজো করলে ত্রিজগৎ পূজকের বশীভূত হয়।” ঠিক এই সময় একজন ব্রাহ্মণী এসে নিজের দুঃখের কথা শিবের কাছে জানালেন তিনি বললেন যে, ওই ব্রাহ্মণ রাজাকে বশীভূত করে রেখেছে এবং তার মত সাধারণ গৃহস্থের অর্থ ও সম্পদ অপহরণ করেছে ঐ ব্রাহ্মণ।ব্রাহ্মণীর এই অভিযোগ শুনে ‌নারদ ব্রাহ্মণীকে সমস্ত কথা সবিস্তারে বলতে বললে, ব্রাহ্মণী বলেন যে তার কন্যার বিবাহের জন্য তার পঙ্গু স্বামী রাজার নিকট অর্থ সংগ্রহ করতে গেলে সেই লব্ধ অর্থের অর্ধাংশ ওই মিথ্যেবাদী ব্রাহ্মণ বলপূর্বক হরণ করেছেন। সমস্ত কথা শুনে নারদ শিবকে জিজ্ঞাসা করেন যে, “হে প্রভু আপনি এইরূপ দুষ্টের পুজো কেন গ্রহণ করছেন?”

 শিব তখন নারদ কে উত্তরে বললেন যে, “নারদ, তুমি আমার প্রিয়তম তোমার যা মন চায় তাই করো,  তুমি এমন কিছু করো যাতে ওই ব্রাহ্মণ তার নিজের পাপের ফল ভোগ করে পুনরায় আমার ভক্ত হয়।”

এরপর নারদ চম্পক বৃক্ষের কাছে গিয়ে বললেন, হে চম্পক বৃক্ষ কোন ব্যক্তি তোমার কাছ থেকে পুষ্প চয়ন করে আমার নিকট সত্যি কথা বলো। চম্পক বৃক্ষ পুনরায় মিথ্যা কথা বলল। এরপর নারদ চম্পক পুষ্পকে শাপ দিলেন। নারদ বললেন, হে চম্পক তুমি ব্রাহ্মণ হয়েও সত্যি কথা বললে না। এখন মিথ্যে কথা বলার ফল তোমাকে দিচ্ছি। আজ থেকে তুমি ত্রিলোক মধ্যে শিব পুজোর অযোগ্য হবে।

এই সময় সেই দুষ্টু ব্রাহ্মণ সেখানে উপস্থিত হলে নারদ তাকে বললেন, তুই ওই রাজা প্রদত্ত ধনের অর্ধাংশ নিয়েছিস, তুই রাক্ষস হ। এই কথা শুনে ব্রাহ্মণ ভীত হয়ে নারদের চরণে পড়ে বলল, “ আমি ভুল করেছি আমার প্রতি কৃপা করুন প্রভু।” নারদ বললেন আমার কথা মিথ্যা হবে না তুমি সত্যই রাক্ষসত্ব লাভ করবে। বিরাট নামে রাক্ষসে পরিণত হবে তুমি। তবে শ্রী রামচন্দ্রের দর্শনপ্রাপ্ত হয়ে ও তার হাতে নিহত হয়ে শংকরের প্রভাবে পুনরায় সুন্দর রূপ লাভ করবে এবং তার ভক্ত হবে।

শিব পুরাণে এই অধ্যায়ের শেষে এই অধ্যায়ের পাঠ মাহাত্ম্যর উল্লেখ আছে। যে ব্যক্তি এই কথা ভক্তি সহকারে শোনে ক্ষণকালের মধ্যে তার সমস্ত পাপের থেকে মুক্তি লাভ হয়।

 

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...