'বুড়ো' শিবের উপাখ্যান

শিব সত্য, শিব সুন্দর, শিব বৃদ্ধও। তাই শিবকে 'বুড়ো শিব' বলে সম্বোধন করা হয়। কেন এমন সম্বোধন করা হয়, তার যেমন বৈদিক ব্যাখ্যা আছে, তেমনি আছে পৌরাণিক গল্পও। সে-সবই আজ আপনাদের শোনাব, শুনুন:

আপনারা জানেন যে, বৈদিক দেবতা রুদ্র পৌরাণিক যুগে এসে 'শিব' নামে সুপরিচিত হয়েছেন। বেদে যে-সকল দেবতার নামে যজ্ঞ বিহিত আছে, তাঁদের মধ্যে রুদ্রের স্থান সর্বাগ্রে। দেবতাদের মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ। তিনিই যজ্ঞের প্রথম ভাগীদার। সে-জন্য তাঁর যজ্ঞভাগকে বলা হয়, 'জ্যেষ্ঠভাগ'। মূলত বহুল প্রচলিত 'জ্যেষ্ঠাংশ' বা 'জ্যেষ্ঠভাগ' কথাটার উদ্ভবই হয়েছে এখান থেকে। 'জ্যেষ্ঠ' মানেই সবার বড়ো, তা থেকেই 'বুড়ো'।

 

BuroShiva1

 

বেদের ব্যাপারটা তো বোঝা গেল। এবার শুনুন পৌরাণিক কাহিনি, 'বরাহ পুরাণ'-এর গল্প:

হিমালয় কন্যা উমা। তিনি চান শিবকে পতি হিসেবে পেতে। কিন্তু ভুতপ্রেতের ভগবানকে জামাই হিসেবে মাতা মেনকা চান না, পিতা হিমালয়ও চান না। আবার শিব উমাকে চান কি না তাও উমার জানা নেই।

তবে, উমা যে আজন্ম অন্তর থেকে মহাদেবকে চান এটা আর কেউ না-জানুক, উমা নিজে তো জানেন। আর এও জানেন যে, যখন কিছু অনিশ্চিত ও অসম্ভব বলে মনে হয়, তখন তা তপস্যা দিয়েই জয় করতে হয়। শিবকেও তিনি সেই তপস্যা দিয়েই জয় করবেন।

যেমন ভাবা, তেমন কাজ। উমা চললেন এক নির্জন গিরিপ্রান্তে তপস্যা করবেন বলে। সেখানে উপস্থিত হয়ে অসাধারণ কৃচ্ছ্রসাধনার মধ্য দিয়ে শুরু করলেন তপস্যা।

উমার সেই তপস্যায় সেই কৃচ্ছ্রসাধনায় মহাদেব তাঁর মনের কথা তো বুঝলেনই, সেই সঙ্গে অতিশয় সন্তুষ্টও হলেন। যে-সিদ্ধির জন্য উমা তপস্যা করছেন, তা তিনিই সানন্দে সিদ্ধ করবেন। কারণ, তাঁর জন্যই তো উমার জন্ম হয়েছে, উমার জন্যই তাঁর অস্তিত্ব। তিনিই বিধি, এ তাঁরই বিধান। তবে সিদ্ধি দিতে তিনি একটু মিষ্টি ছলনার আশ্রয় নেবেন।

ফলে, অবিলম্বেই মহাদেব শিব অতি জরাগ্রস্ত এক ব্রাহ্মণ বৃদ্ধের রূপ ধারণ করলেন। তারপর ধীর-মন্থর গতিতে জরাগ্রস্তরা যেমন করে হাঁটে, তেমনি করে হেঁটে হাজির হলেন উমার তপস্যাভূমে। কম্পিত ক্ষীণ অথচ কাতরকণ্ঠে বললেন, ও মেয়ে, আমি খুব ক্ষুধার্ত, পথশ্রমে ক্লান্ত, আমায় কিছু খেতে দেবে গো!

 

BuroShiva2

 

তপস্বিনী উমা তপস্যার আসনে বসেছিলেন তখন। যদিও তিনি মগ্ন ছিলেন, তথাপি বৃদ্ধের কাতরকণ্ঠ তাঁর অন্তরে গিয়ে পৌঁছল। তিনি চোখ খুললেন। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বয়সের ভারে অবনত, ক্লান্তি ও ক্ষুধায় শুষ্ক বৃদ্ধের বলিরেখাময় মুখটির দিকে তাকিয়ে উমার ভারি মায়া হল। তিনি সস্নেহে বললেন, হে ব্রাহ্মণ, আমার কাছে কিছু সুস্বাদু ফল আছে। তাই দিয়েই আমি তোমার আহারের ব্যবস্থা করছি। ততক্ষণে তুমি বরং গঙ্গার জলে স্নান করে পথশ্রমের ক্লান্তি দূর করে এসো।

উমার কথা শুনে বৃদ্ধের মুখে প্রসন্নতার আভা দেখা গেল। তিনি বললেন, বেশ। তারপর পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করলেন গঙ্গার দিকে।

উমার তপস্যাভূমের অদূরেই বয়ে চলেছেন পুণ্যসলিলা গঙ্গা। সেখানে এসে লীলাময় শিবশঙ্কর বক্ষ্যমাণ লীলাকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা করলেন। অচিরেই জলে নেমে তিনি মায়াময় এক বীভৎস ও বিকাটাকার কুমীর সৃষ্টি করলেন। তাঁরই মায়ায় সেই কুমীর তাঁকেই আক্রমণ করতে ছুটে এল। আর তখনই বৃদ্ধরূপে শিব শুরু করলেন মরণ-চিৎকার, ও মেয়ে, এক্ষুনি এসো! কুমীরে খেয়ে ফেলল, আমায় বাঁচাও!

উমা বৃদ্ধের আহারের উদ্যোগ করছিলেন, আর্তচিৎকার শুনে ঘোর বিপদের আশঙ্কায় অমনি ছুটে এলেন নদীতীরে। দেখলেন, একটি বীভৎস-বিকটাকার কুমীর বৃদ্ধকে খেয়ে ফেলতে ছুটে আসছে দূর থেকে। বৃদ্ধ এমন ভয় পেয়েছেন যে, জল থেকে কিছুতেই উঠে আসতে পারছেন না। হাত বাড়িয়ে বার বার উমার সাহায্য চাইছেন টেনে তোলার জন্য।

 

BuroShiva3

 

গতিক দেখে উমা পড়লেন উভয়সঙ্কটে। তিনি কখনও পরপুরুষকে স্পর্শ করেননি। বৃদ্ধকে স্পর্শ করলে তাঁর সেই স্পর্শদোষ হবে। আবার সম্মুখে ব্রাহ্মণকে মৃত্যুমুখে পড়তে দেখে সাহায্য না-করলেও হবে ব্রহ্মহত্যার পাপ। মুহূর্তের দ্বিধাচলতা পেরিয়ে অবশেষে উমা দ্বিতীয় দোষটিকেই মারাত্মক বিবেচনা করে বৃদ্ধকে টেনে তুলতে হাত বাড়িয়ে দিলেন।

সুতরাং, বৃদ্ধ তাঁর হাতটি সপাটে ধরলেন। অমনি মুহূর্তেই কুমীর অদৃশ্য হয়ে গেল। সেই সঙ্গে বৃদ্ধও উমার হাত ধরে নিজের দিকে প্রবল বেগে আকর্ষণ করতে লাগলেন। তাতে উমা অত্যন্ত অবাক হয়ে রেগে ওঠার উপক্রম করতেই শিবশঙ্কর আপন স্বরূপে আবির্ভুত হলেন। বললেন, তুমি তো চেয়েইছিলে উমা আমি তোমার পাণিগ্রহণ করি, এই দেখো সত্যিই তোমার পাণিগ্রহণ করেছি!

শিবের কথা শুনে উমা আর রাগ করবার কোন কারণ দেখলেন না, বরং খানিক লজ্জিত হলেন। তারপর পিতার কাছে স্বয়ং মহাদেবের পাণিগ্রহণের সংবাদ দিলেন। উমাকে অবাক করে তাই শুনে পিতাও এবার বিয়েতে রাজি হলেন। মাতাও রাজি হয়ে গেলেন।

সুতরাং, ব্রহ্মার উপদেশ নিয়ে অচিরেই খুব ধুমধাম করে ত্রয়োদশী তিথিতে উমা-মহেশ্বরের বিয়েও হয়ে গেল।

তারপর দিন গেল, কাল গেল। তবু বিবাহ-লীলায় বুড়ো সাজার জন্য মহেশ্বরের 'বুড়ো' বদনাম আর কোনদিনই গেল না। এখনও হামেশাই শিবের মন্দিরে গেলে ভক্তেরা বলেন, 'বাবা বুড়ো শিবের মন্দিরে যাচ্ছি...'। গাজনে ভক্ত্যার দল এখনও ফি বছর ধ্বনি তোলেন, 'বাবা বুড়ো শিবের চরণে সেবা লাগে...'।

এটা শেয়ার করতে পারো

...

Loading...